বাংলা কথাসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম উপন্যাস ‘আরণ্যক’। লেখক বনবিভাগে কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে উপন্যাসটি রচনা করেন। এটি মূল বাংলা ছাড়াও সাহিত্য আকাদেমির প্রচেষ্টায় ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যেমন- ওড়িয়া, তেলেগু, গুজরাটি, মারাঠী, মালয়ালাম, পাঞ্জাবী এবং হিন্দি। আরণ্যক তাঁর চতুর্থ উপন্যাস। রচনাকাল ১৯৩৭-৩৯ খ্রিস্টাব্দ।
১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভাগলপুরে থাকাকালে বিভূতিভূষণ ‘আরণ্যক’ লেখার পরিকল্পনা করেন। ঐ সময় পাথুরিয়াঘাটা এস্টেটের সহকারী ম্যানেজার হিসেবে ইসমাইলপুর এবং আজমাবাদের অরণ্য পরিবেশে থাকার ফলে আজন্ম নিসর্গরূপকার বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় (১২ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪ – ১ নভেম্বর, ১৯৫০) নানা বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করেন। চাকরির সুবাদে তিনি যা কিছু উপলব্ধি করেছেন, তারই জীবন ঘনিষ্ঠ এক চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় আরণ্যক উপন্যাসে।
বিহারের পূর্ণিয়া জেলায় কুশী নদীর অপর পারের আজমাবাদ, লবটুলিয়া, ইসমাইলপুর সংলগ্ন বিস্তৃত অরণ্যময় অঞ্চলটি হচ্ছে আরণ্যক উপন্যাসের মূল পটভূমি। বনের অশিক্ষিত দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জীবনধারা আর প্রকৃতির স্বতন্ত্র এক মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে আছে তাঁর এই উপন্যাসে। এর কাহিনি আঠারো পরিচ্ছেদে বিভক্ত।
উপন্যাসের মূল চরিত্র সত্যচরণ নামে এক যুবকের পনের ষোল বছর আগের স্মৃতিচারণে গড়ে উঠেছে এর কাহিনি। বিএ পাস বেকার যুবক সত্যচরণ তার এক বন্ধুর সহায়তায় ভাগলপুরের কাছে এক জঙ্গলাবৃত এলাকায় জমিদার এস্টেটের একজন ম্যানেজারের চাকরি পায়। কয়েক হাজার বিঘা জঙ্গল পরিষ্কার করে খাজনা আদায় এবং প্রজাবিলি করার চুক্তিতে তার চিরপরিচিত ব্যস্ত কলকাতা শহর ত্যাগ করে পাড়ি জমায় দূরে অরণ্যের কোলে।
প্রথমদিকে গ্রামীণ অরণ্যের নিস্তরঙ্গ জীবনের সঙ্গে তার ব্যস্ততা, কোলাহলমুখরতায় অভ্যস্ত শহুরে মন মানিয়ে নিতে পারে না। আস্তে আস্তে প্রকৃতির সৌন্দর্য আর মোহে নিজেকে হারাতে থাকে সত্যচরণ। প্রকৃতি-সুন্দরীর মায়ায় অনুঘটক রূপে কাজ করেছে উপন্যাসের অপরাপর চরিত্রগুলো। যুগলপ্রসাদ, রাজু পাঁড়ে, মটুকনাথ, ধাতুরিয়া, ধাওতাল সাহু, যুগলপ্রসাদ, ভেঙ্কটেশ্বর, কুন্তা, মঞ্চী, নকছেদী ভক্ত, রাজা দোবরু পান্না, রাজকন্যা ভানুমতী- আরও কত চরিত্র, কত বিচিত্র জীবন। এরা প্রত্যেকেই অরণ্য আশ্রয় আশ্রিত নীচুতলার মানুষ।
উপন্যাসের শুরুতে কথকের কাছে এরা নিতান্ত বর্বর বলে গণ্য হয়। কিন্তু সময়ের পথচলায় একসময় তিনি নিজেকে এদের জীবনপ্রবাহে এমনভাবে অঙ্গীভূত করেন যে, নিজেকেই এদের রহস্যময় সরল সাধারণ জীবনে অপাংক্তেয় মনে হতে থাকে। এক সময় এরাই তার কাছে হয়ে ওঠে একেকজন বিস্ময়মানব।
লেখক প্রকৃতির নিবিড় রহস্যময়তা, আদিম অরণ্যে খুঁজে পেয়েছেন জীবনের গাঢ়তম এক রূপ। উপন্যাসের নায়ক সত্যচরণ শহর থেকে গ্রামীণ এস্টেটে গিয়ে মিশেছে এই পটভূমিতে। উপন্যাসে তাকে আমরা পাই সৌন্দর্যবোধসম্পন্ন একজন উদারমনা যুবক হিসেবে। তার মূল দায়িত্ব ছিলো এলাকার অরণ্য নিধন করে তাকে আবাদ কিংবা বসোপযোগী করে জমিদারকে বৈষয়িক লাভের সন্ধান দেয়া।
অরণ্য প্রকৃতির গভীর থেকে গভীরে সে প্রবেশ করেছে। অব্যক্ত রহস্য থরে থরে সাজিয়েছেন প্রকৃতিমাতা, তার সন্ধান করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করেছে কী অদ্ভুত রোমান্স এই মুক্ত জীবনে। শুধু প্রকৃতির প্রেমই নয়, সেখানকার মানুষের ঐহিত্যকে নিজের মধ্যে লালিত করতে চেয়েছে। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ সত্যচরণকে যতটা ভাবুক বানিয়েছে, তার থেকে বেশি প্রভাবিত করেছে বুনো মানুষের সহজ সরল জীবন।
লেখকের প্রতিনিধি সত্যচরণ মধ্যশ্রেণীর একজনরূপে প্রত্যক্ষ করে দুই শ্রেণীর সমৃদ্ধি এবং উল্লাসের বিপরীতে বঞ্চনা আর হাহাকার। ক্ষয়িষ্ণু সাঁওতাল রাজা দোবরু পান্না ও তার পরিবারের সান্নিধ্যে এসে সত্যচরণের নতুন উপলব্ধি ঘটেছে। তাদের জীবনকথা, তাদের ইতিহাস সত্যচরণের মনে জাগিয়েছে আর্য ও অনার্যের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের বৃহত্তর পটভূমি।
আবার রাজা দোবরুর সমাধিতে ফুল ছড়িয়ে দিয়ে সত্যচরণ আর্যজাতির একজন হয়ে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে আর্য ও অনার্যের অন্তরসত্তাকে বাঁধতে চেয়েছে শ্রদ্ধার বন্ধনে। বিদায় বেলায় অরণ্যানীকে রক্ষা করতে না পারার সূক্ষ্ম বেদনার স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে তার করুণ আর্তিতে। পরাজিত আত্মার সমাধির ওপর নগরসভ্যতার যে তাজমহল তৈরি হচ্ছে তাতে তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।
তাইতো বিদায়বেলায় আক্ষেপ করে সত্যচরণ বলে,
‘হে অরণ্যানীর আদিম দেবতারা,
ক্ষমা করিও আমায়।’
উপন্যাসের শেষে সত্যচরণের এই মর্মবেদনা এবং বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের জীবনদর্শনের অনন্য রূপায়নে আরণ্যক হয়ে উঠেছে এক মায়াময় উপাখ্যান।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ
আনন্দবাজার/শহক