প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে চারদিনের সরকারি সফরে আগামীকাল ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ পর্যন্ত দেশটিতে সফর করবেন। তাঁর সফর ঘিরে ইতোমধ্যে কূটনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক অর্থনীতি, বাণিজ্য, আন্তঃসীমান্ত নদী ও রাজনৈতিক বিষয়ে কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে বিশেষ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে দৈনিক আনন্দবাজারে।
ভারত-বাংলাদেশ রেলসেবা বিষয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে সোমবার। তার আগে আজ বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে রেলপথে নিয়ে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজনের বিশেষ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো। গত ১ সেপ্টেম্বর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দৈনিক আনন্দবাজারের বিশেষ প্রতিনিধি অশোক দত্ত ও নিজস্ব প্রতিনিধি ফারুক আহমাদ আরিফ।
এখন অবধি ভারতের সঙ্গে চালু হওয়া রেলপথের মাধ্যমে বাণিজ্যিক কী কী সুবিধা হয়েছে?
প্রায় ২৫ লাখ পর্যটক যায়। যদিও ভারতের দিক থেকে আমাদের দেশে কম আসে। তবে মানুষ তো যাওয়া-আসা করছে। এতে সবার উপকারে আসছে। বাণিজ্যিকভাবে আমরা বিভিন্ন পণ্য সহজেই ও অল্প খরচে আনতে পারছি। আবার ভারতেও রপ্তানি করছি।
কতগুলো প্রকল্প চলছে?
ভারতীয় বিনিয়োগে ১৭টি প্রকল্পের মধ্যে ৯টির কাজ ইতোমধেই সম্পন্ন হয়েছে। দুটি প্রকল্পের চুক্তি কয়েকদিন আগে হলো। তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন চলমান। বাকি তিনটি প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের জন্য দরপত্র আহ্বানের কাজ চলমান। এ সবের মধ্যে খুলনা থেকে মোংলা বন্দরের সঙ্গে আগে যোগাযোগ ছিল না। এখন নতুন লাইন করা হচ্ছে। তাতে রেলপথে যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সেখানে আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিবহণ দুটি ক্ষেত্রেই উপকার হবে। যেমন-ভারত ও নেপাল সরাসরি এই পথে রেলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুক্ত হবে।
মিয়ানমারের সঙ্গে এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে রেল লাইনের প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কত দূর?
এটি এশিয়ান হাইওয়ের একটি রোড। এটি চীনের কুমবিং থেকে মিয়ানমারের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশ হয়ে ভারতের কলকাতার সাথে যুক্ত হবে। আমরা কক্সবাজার পর্যন্ত রাস্তা বানিয়ে ফেলেছি। রামু থেকে দুমদুম পর্যন্ত কিছুটা বাকি। তবে মিয়ানমারের দিক থেকে কাজের অগ্রগতি অনেক কম। সেজন্য আমরা একটু ধীরে চলছি।
ভারতীয় এক পত্রিকার সম্পাদককে কয়েক বছর আগে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পভাবে সাজানো হলে এখানে পঙ্গপালের মতো ভারতীয় আসবে’- এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়নে রেলওয়ের কী ধরনের পরিকল্পনা আছে?
পর্যটনের জন্য নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থা সবসময় কাঙ্ক্ষিত। কেউ কোনো হেজার্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় না। আমাদের এখন কক্সবাজারের সঙ্গে রেলে যোগাযোগের ব্যবস্থা হয়েছে। এর আগে কোনো সরকার এ বিষয়ে চিন্তাই করেনি। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করে ফেলেছে। এটি প্রধানমন্ত্রীর ১০টি অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পের একটি ছিল। এই যে পদ্মা সেতু দিয়ে কলকাতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়া যাচ্ছে। এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হওয়া যাবে। আমরা ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম থেকে চাল কিনছি। এগুলো রেলপথে আনা যাবে। ভারত থেকে ডিজেল কিনছি। শিলিগুঁড়ি থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত পাইপলাইন হচ্ছে, সরাসরি তেল নিয়ে আসবে। ভারত থেকে বিদ্যুৎও নিয়ে আসা হচ্ছে। এখানে আঞ্চলিক যোগাযোগকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। আমাদের অনেক বিদেশি বন্ধু থাকলেও প্রতিবেশীই বেশি অগ্রাধিকার পাবে। আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার বৈদেশিক নীতিকে সবসময় গুরুত্ব দেয়। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’। এই মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজ করছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশের মাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ও অস্থিতিশীল গোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।
তাহলে কি জিরো টলারেন্স?
হ্যাঁ, জিরো টলারেন্স। শুধু মুখে নয়, প্রধানমন্ত্রী বাস্তব কাজের মাধ্যমে এটি পরিপূর্ণভাবে প্রমাণ করছেন। আন্তর্জাতিকভাবে আজ বাংলাদেশের যে অগ্রগতি-সম্মান তা শেখ হাসিনার সরকারের অনুসৃত নীতির কারণে সম্ভব হয়েছে। আমরা সবসময় বাংলাদেশের, জনগণের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছি।
আঞ্চলিক যোগাযোগে রেলপথের উন্নয়নে ভারত কি ধরনের অংশীদার?
ভারত আমাদের অন্যতম বড় অংশীদার। বিশেষ করে রেলপথ যোগাযোগ উন্নয়নে ভারত অন্যতম প্রধান উন্নয়ন সহযোগী।
মৈত্রী, মিতালী ও বন্ধন নামে ভারত-বাংলাদেশ তিনটি যাত্রিবাহী রেলসেবা চালু আছে। এর প্রতিবন্ধকতা ও সফলতা কী?
আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে যমুনা সেতু। রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী ও খুলনা, নীলফামারী, কুড়িগ্রামের ট্রেন এই সেতু দিয়ে পার হয়ে আসে। পাবনার ঈশ্বরদী থেকে গাজীপুরের টঙ্গী পর্যন্ত একটা লাইন। এক লাইনে রেল যাচ্ছে ও আসছে। এখানে বেশি রেল অপারেট করা যাচ্ছে না। যে কারণে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় রেল সেতুটি ডাবল লাইন ডুয়েল গেজ হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডাবল লাইনের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে সিরাজগঞ্জ হয়ে বগুড়া। ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডাবল লাইন করতে পারলে এবং ২০২৪ সাল পর্যন্ত পদ্মা লিঙ্ককে কানেক্ট করা গেলে ২০২৫ সালের মধ্যে যুগান্তকারী অবস্থান তৈরি হবে। কেননা পূর্বাঞ্চলে কিন্তু সিডিউল বিপর্যয় সেই অর্থে নেই। ময়মনসিংহ লাইন, চট্টগ্রামে মিটার গেজ চলে ডাবল লাইন কিছু অংশ বাদে। কিশোরগঞ্জ হয়ে চট্টগ্রাম, আখাউড়া হয়ে সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগ। এতে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ কাঠামো গড়ে উঠছে। পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগে বড় বাধা যমুনা নদী। বঙ্গবন্ধু রেল সেতু হয়ে গেলে আমূল পরিবর্তন আসবে। ইতোমধ্যে থার্ড লাইন, ফোর্থ লাইন হচ্ছে। টঙ্গী হতে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার ডাবল লাইন হচ্ছে। তারপর জয়দেবপুর হতে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডাবল লাইন করতে পারলে যোগাযোগ আরও সহজ হয়ে যাবে। জয়দেবপুর থেকে জামালপুর পর্যন্ত ডাবল করার চিন্তা আছে।
পদ্মা সেতুতে রেলের একটামাত্র লাইন অর্থাৎ সিঙ্গেল লাইন, এটিকে শতবছরের কান্না বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতু হবে কিনা সেটাই সন্দেহ ছিল। সেখানে রেললাইন পরের কথা। প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও একাগ্রতার কারণে সেটি সম্ভব হয়ছে। সেখানে আমরা রেললাইনের প্রকল্প নিয়ে বাস্তবায়ন করছি। সেখানে ব্রডগেজে করা হয়েছে ডুয়েল গেজ নয়। আমাদের মিটার গেজ আছে, যেখানে মিটার গেজ আছে সেখানে এটির অপারেশন ঠিক রাখতে হবে। আবার যেখানে ব্রডগেজ আছে সেখানে যুক্ত করা হবে।
রেলের অনেক ভূমি বা জমি বেহাত বা দখল হয়ে আছে। এসব উদ্ধারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে?
রেলের সব জমি বেহাত হয়েছে বা ফাঁকা পড়ে আছে বিষয়টি তেমন না। আমরা যে নীতিতে এগুচ্ছি সেখানে জনগণ আগে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন মানুষকে উচ্ছেদের আগে তার বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের দিকে খেয়াল রাখতে। তাকে পুনর্বাসন করতে। প্রয়োজনে আমরা লোকদের রেলওয়ের জমি থেকে উচ্ছদ করবো, তবে কোনো পরিকল্পনা ছাড়া হুদাই কাউকে বাসস্থান বা কর্মসংস্থান নষ্ট করা হবে না। প্রধানমন্ত্রী ক ও খ নামে দুটি শ্রেণি করে দিয়েছেন। ক শ্রেণির জনগণ যাদের জমি আছে ঘর নেই, তাদের ঘর করে দিচ্ছেন। খ শ্রেণি যাদের জমি ও ঘর কোনটায় নেই, তাদের ঘর করে দিচ্ছেন। তাছাড়াও অনেক ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা বলয় কর্মসূচির আওতায় ভাতা দিচ্ছেন।
দুটো ইন্টারচেঞ্জ তো এখনও বন্ধ। সেখানে কাজ শুরু হয়নি?
উত্তর: ইন্টারচেঞ্জের ব্যাপারে আমরা রেস্টোর করতে পারছি না। যতক্ষণ পর্যন্ত না বুড়িমারিতে ব্রড গেজ করতে পারছি ততক্ষণ ইন্টারচেঞ্জ করা যাচ্ছে না। আরেকটি মোঘলহাট যা কুড়িগ্রাম থেকে ৬/৭ কিলোমিটার। অন্যটি হচ্ছে ফেনী থেকে বিলোনিয়া।
এ দুটির কাজ কি তাড়াতাড়ি শুরু হবে?
কয়েকদিন আগে কাউনিয়া থেকে বুড়িমারি এবং কাউনিয়া থেকে মোঘলহাট পর্যন্ত ডুয়েল গেজের চুক্তি হয়েছে। আরেকটি হচ্ছে চিলমারি প্রকল্প। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সার্ভে হয়নি।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও।
আনন্দবাজার/শহক