ঢাকা | সোমবার
২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুপেয় পানির তীব্র সংকট

সুপেয় পানির তীব্র সংকট

রাজশাহীর তানোর উপজেলার বাঁধাইড় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) বহরইল গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল লতিফ। তাদের বাড়িতে নেই টিউবওয়েল। শুধু কি টিউবওয়েল, গ্রামের গভীর নলকূপটিও আজ অকেজো। খাবার পানি আনতে তার পরিবারের লোকজনকে এক কিলোমিটারের বেশি রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। বহরইল গ্রামসহ আশেপাশের গ্রামগুলোর একই অবস্থা। বিশুদ্ধ পানি সংকট দিনে দিনে চরমে উঠছে।

বরেন্দ্র অঞ্চলের বিশুদ্ধ পানির সংকট দিনে দিনে চরম আকার ধারণ করছে। বৃষ্টিপাত না হওয়ায়, সেই সঙ্গে ভূ-গর্ভস্থ পানি ভয়ঙ্করভাবে নিচে নেমে যাওয়ায় এ সংকট চরমে উঠেছে।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুণ্ডুমালা পৌরসভা সদরেও একই অবস্থা। পৌরসভার সদরের বাসিন্দা গৌতম কর্মকার জানান, তার বাড়িতে টিউবওয়েল অনেক আগেই বাদ হয়ে গেছে। এখন যে সাবমার্সেবল পাম্প আছে তা থেকে তাতেও উঠছে না পানি। পাশের গ্রাম থেকে তাদের পানি নিয়ে আসতে হয়।

রাজশাহী অঞ্চলে ভয়ঙ্করভাবে নেমে যাচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব ও দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপকহারে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। এতে করে জনস্বাস্থ্য পড়েছে হুমকির মুখে।

ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে বেশিরভাগ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। এ উপজেলায় ৩ হাজার ৫৪৯টি টিউবওয়েল অকেজো হয়ে পড়েছে। সরকারি মোট ৫ হাজার ১৬৬টি টিউবওয়েলের মধ্যে ৩ হাজার ৫৪৯টি টিউবওয়েল অকেজো। এতে করে ঝুঁকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। যে টিউবওয়েল গুলো সচল আছে তাতে পানি উঠার পরিমাণ কমে গেছে।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গোদাগাড়ী উপজেলার গোদাগাড়ী ইউনিয়নে ২০১৯ সালে পানির সর্বনিম্ন ছিল ৮৫ ফুট, ২০২২ সালে নিচে নেমে হয়েছে ৯৫ ফুট, রিশিকুল ইউনিয়নে ২০১৯ সালে পানির সর্বনিম্ন স্তর ছিল ৮০ ফুট, ২০২২ সালে নিচে নেমে হয়েছে ৯৫ ফুট। অন্য ইউনিয়নগুলোর চিত্রও একই।

গোদাগাড়ী উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী শাহীনুল হক বলেন, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার ফলে ভূ-গর্ভস্থে পানি রিচার্জ হচ্ছে না। যার ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। পানি না পাওয়ায় টিউবওয়েল গুলো অকেজো হয়ে যাচ্ছে। এ অঞ্চলে গাছপালা লাগানো প্রয়োজন যাতে করে বৃষ্টিপাত বেশি হয়। বৃষ্টিপাত বেশি হলে ভূ-গর্ভস্থে পানি রিচার্জ হবে, এতে করে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।

বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় সরকারের পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) কাজ করছে। ওয়ারপো ২০২১ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হাইড্রোলজিক্যাল মডেলিংয়ের মাধ্যমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় মাটির নিচে পানির উপস্থিতি পরীক্ষা করে। ওই তিন জেলার ৫০টি স্থানে এ পরীক্ষা চালানো হয়। অনেক জায়গায় প্রায় দেড় হাজার ফুট পর্যন্ত গভীরে গিয়েও কোনো পানি পাওয়া যায়নি।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুন্ডুমালা পৌর এলাকাসহ আশেপাশের ইউনিয়ন, নওগাঁর পোরশার ছাওড় ইউনিয়ন এবং সাপাহার উপজেলার সদর ইউনিয়ন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলসহ মোট পাঁচটি স্থানে পানির স্তরই পাওয়া যায়নি। ওইসব এলাকায় কিছু কিছু পকেট স্তর মিলেছে। তাও সামান্য। ধারণা করা হচ্ছে যে হারে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে তাতে খুব তাড়াতাড়ি পকেট স্তরগুলো শেষ হয়ে যাবে।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার পাঁচন্দর গ্রামের আসাদুজ্জামান মিঠু জানান, খাবার পানির সংকট দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০ বছর পরে পানির জন্য এ অঞ্চলে হাহাকার পড়বে।
বরেন্দ্র অঞ্চলে সবচেয়ে উঁচু গোমস্তাপুরের পার্বতীপুর ইউনিয়ন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও গোমস্তাপুর, রাজশাহীর তনোর ও গোদাগাড়ী এবং নওগাঁর পোরশা, সাপাহার এবং নিয়ামতপুর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কমপক্ষে ৪৭ মিটার উঁচু। এসব এলাকায় এখন পানির জন্য হাহাকার চলছে। এ পানি সংকটের অন্যতম কারণ ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন। যে যেভাবে পারছে সেভাবে পানি উত্তোলনের কারণে এ অঞ্চলের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) ১৯৮৫ সাল থেকে এ অঞ্চলে গভীর নলকূপ বসাতে শুরু করে। সমগ্র বরেন্দ্র এলাকায় ১৫ হাজার ১০০টি গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উঠানো হতো। কিন্তু দিনে দিনে পানির স্তর নিচে নামতে থাকায় ২০১২ সালের দিক থেকে বিএমডিএ গভীর নলকূপ স্থাপন বন্ধ করে দেয়। এরপরেও এ অঞ্চলে ৮ হাজারের বেশি গভীর নলকূপ এখনো চালু আছে। এর পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকাধীন অসংখ্য নলকূপ বসানো হয়েছে। যা থেকে জমিতে সেচ দেয়া হয়।

বিএমডিএ’র তথ্য অনুযায়ি, বরেন্দ্র অঞ্চলের বার্ষিক ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৭১০ মিলিয়ন ঘনমিটার। এই পরিমাণ পানি এক বিঘা আয়তনের দুই মিটার গভীরতা বিশিষ্ট ১৮ লাখ পুকুর ভরে ফেলার জন্য যথেষ্ট।

রাজশাহী অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। দেশের অন্য অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের অর্ধেক এ অঞ্চলের বৃষ্টিপাত। দেশের গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার। এ বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত মাত্র ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার। সে কারণে এ অঞ্চলে বৃষ্টির পানি হতে ভূ-গর্ভস্থ পানির রিচার্জের হারও কম। বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্থ পানির গড় পুনর্ভরণের হার দেশে ২৫ শতাংশ হলেও এ অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ।

এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৯৮০ সালেও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ছিল মাটির মাত্র ৩৯ ফুট নিচে। ২০১৬ সালে তা তিনগুণ নেমে গিয়ে ১১৮ ফুট নিচে নেমে যায়। ২০২২ সালে এসে অনেক জায়গায় মিলছে না কোনো পানির স্তর। এ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় যে বরেন্দ্রের পানি কতো দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে।

অস্বাভাবিকভাবে ভূ-গর্ভের পানি উত্তোলনের জন্য দিনে দিনে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চল। সাধারণত ১৫০ থেকে ২০০ ফুট মাটির গভীরে পানির স্তর পাওয়ার কথা। দিনে দিনে যেভাবে পানির স্তর নামছে তাতে এ অঞ্চলের বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান জানান, যতো দিন যাচ্ছে পরিস্থিতি ততো খারাপের দিকে যাচ্ছে। অস্বাভাবিকভাবে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার এই অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানি দুষ্প্রাপ্য করে তুলতে পারে।

তিনি আরও বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলকে বাঁচাতে হলে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ পানির স্তর নিচে নেমে গেলে নিচে বালু, পাথর ফাঁকা হয়ে পড়বে। তখন সামান্য ভূমিকম্প হলেই দেবে যেতে পারে বিশাল এলাকা। ভূ-গর্ভস্থ পানি সেচ কাজে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন