খোয়াই, ধরলা, দুধকুমার, মনু, মুহুরী ও গোমতী
ভারত-বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছয়টি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে জেআরসিতে আলোচনা হয়েছে। এসব নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দুদেশের মধ্যে নানা আলোচনা বিতর্ক ছিল। তবে সাম্প্রতিক জেআরসি বৈঠকে শেষ অবধি ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে।
খোয়াই নদী
খোয়াই নদী বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলায় বয়ে চলেছে। এর দৈর্ঘ্য ১৬৬ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১০৬ মিটার এবং সর্পিলাকারের। খোয়াই ভারতের ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এর উৎপত্তিস্থল ত্রিপুরার আঠারমুড়া পাহাড়। এটি ত্রিপুরার তৃতীয় দীর্ঘতম নদী। সেখান থেকে উত্তর-পশ্চিম মুখে প্রবাহিত হয়ে সিলেট জেলার বাল্লা নামক স্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে হবিগঞ্জ জেলার পূর্বপ্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ভারতের খোয়াই এলাকার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে বলে ঐ এলাকার নামানুসারে এর নাম করণ করা হয়েছে ‘খোয়াই’।
নদী নিয়ে দৈনিক আনন্দবাজারের কয়েকটি বিশেষ প্রতিবেদন- তৃতীয় পর্ব- তিস্তা-কুশিয়ারায় সুখবর দ্বিতীয় পর্ব- ত্রিপুরার বর্জ্যে ধুঁকছে তিতাস প্রথম পর্ব- বাঁধনহারা নদীর স্বপ্ন
ধরলা নদী
ধরলা নদী বাংলাদেশ-ভারত-ভুটানের আন্তঃসীমান্ত নদী। উৎপত্তিস্থল হিমালয়ে জলঢাকা বা শিংগিমারি নামে পরিচিত। নদীটি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে এবং বাঁক নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে আবারো বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জলঢাকা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে মূলত ধরলা নামেই কুড়িগ্রামের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। মোট দৈর্ঘ্য ২০৯ কিলোমিটার, বাংলাদেশ অংশে ধরলার দৈর্ঘ্য ৭৫ কিলোমিটার। এর গড় গভীরতা ১২ ফুট বা ৩.৭ মিটার এবং কুড়িগ্রামে সর্বোচ্চ গভীরতা ৩৯ ফুট বা ১২ মিটার।
উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে দীর্ঘ সড়ক সেতুটি এই নদীর ওপর অবস্থিত। ৯৫০ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট পিসি গার্ডার সেতুটি দ্বিতীয় ধরলা সেতু/শেখ হাসিনা ধরলা সেতু নামে ২০১৮ সালে চালু হয়। ২০০৭ সালে ধরলা নদী ও যমুনা নদীর ভাঙ্গনে কুড়িগ্রামের ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২ কিলোমিটার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এতে মসজিদ, মন্দির, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ফসলসহ আবাদযোগ্য জমি নদীগর্ভে হারিয়ে তিন হাজারের অধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে।
দুধকুমর নদ
দুধকুমর নদ বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী। দৈর্ঘ্য ১৬ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ২৪ মিটার এবং সর্পিলাকার প্রকৃতির। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রায়ডাক নদী বা সঙ্কোশ নদী পাটেশ্বরীর কাছে দুধকুমর নাম ধারণ করেছে। একেবারে উত্তর সীমানার নদী দুধকুমর। দুধকুমর নদের জন্ম মূলত ভারতের সিকিম রাজ্যে। তিস্তা নদীর সমান্তরালে উত্তরমুখী হয়ে ধরলা ও দুধকুমর নদ দুটি মিলিতভাবে বয়ে গেছে। রংপুরে নীলকুমার নামে একটি নদী এর সাথে মিশেছে। নদীটি পাটেশ্বরীতে গদাধর ও গঙ্গাধর নদী দুটিকে উপনদী হিসেবে গ্রহণ করে আঁকাবাঁকা পথে প্রায় ৫২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়েছে।
গোমতী নদী
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর-পূর্বপ্রান্তীয় পার্বত্য অঞ্চল ডুমুর নামক স্থান থেকে উৎপন্ন গোমতী নদী। নদীটি উৎস থেকে পার্বত্যভূমির মধ্য দিয়ে ১৫০ কিমি সর্পিলপথ পার হয়ে কুমিল্লা সদর উপজেলার কটক বাজারের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর আঁকাবাঁকা প্রবাহপথে কুমিল্লা শহরের উত্তরপ্রান্ত এবং ময়নামতীর পূর্বপ্রান্ত অতিক্রম করে বয়ে চলেছে। প্রবাহপথের উত্তর দিকে বুড়িচং উপজেলাকে ডানে রেখে দেবিদ্বার উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কোম্পানীগঞ্জ বাজারে পৌঁছেছে।
ময়নামতি থেকে কোম্পানীগঞ্জ বাজার পর্যন্ত নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার। কোম্পানীগঞ্জ থেকে পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে শেষাবধি দাউদকান্দি উপজেলার শাপটা নামক স্থানে এসে মেঘনায় পড়েছে। এখানে নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে গোমতী নদীর মোট দৈর্ঘ্য ১৩৫ কিমি। গোমতীর গুরুত্বপূর্ণ উপনদীসমূহের একটি ডাকাতিয়া এবং শাখা বুড়ি নদী।
গোমতী তীব্র স্রোত সম্পন্ন পার্বত্য নদী। কুমিল্লায় প্রবাহমাত্রা ১০০ থেকে ২০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত উঠানামা করে। বর্ষাকালীন গড় প্রশস্ততা ১০০ মিটার, স্রোতও হয় দ্রুতগতির। শীত মৌসুমে গতিধারা সংকীর্ণ হয়ে আসে এবং অধিকাংশ স্থানে হেঁটেই নদী পার হওয়া যায়। স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের বছরে পানির উচ্চতা পার্শ্ববর্তী এলাকার স্তর থেকে ১.৫ মিটারের ওপরে বৃদ্ধি পায়। আকস্মিক বন্যা নদীটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। নদীটি একসময় ‘কুমিল্লা শহরের দুঃখ’ হিসেবে পরিচিত ছিল। বন্যা প্রতিরোধে ভেড়িবাঁধ এবং নদীর গতিপথ সোজা রাখতে ১৯টি লুপকাট নির্মাণ করা হয়েছে। নদীটিতে বৃহৎ নৌকা চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় নাব্যতা নেই।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, উজানে ভারতে নদীর মধ্যে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নেওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ অংশে পানি আসছে না। যে কারণে নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত নদীতে পানি একেবারেই কম থাকে, এতে সেচকাজ ব্যাহত হয়। পুরাতন গোমতী নদীর চানপুর এলাকায় নদীর মধ্যে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা হয়েছে। নদীর পাড়ে শত শত দখলদার।
মুহুরী নদী
মুহুরী নদী বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ফেনী জেলায় প্রবাহিত। নদীটির দৈর্ঘ্য ৬২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৭১ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। মুহুরি নদীটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পার্বত্যাঞ্চলে উৎপন্ন। খরস্রোতা নদীটি পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফেনীর পরশুরাম উপজেলার নীজকালিকাপুর এবং মাঝিরখালী গ্রামের কাছে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং ফেনী নদীর সাথে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত। তা ছাড়া মুহুরী ত্রিপুরার লুসাই পাহাড় হতে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিমে ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়ার পূর্বে চট্টগ্রাম এবং ফেনী জেলাকে পৃথক করেছে।
মুহুরী ত্রিপুরা-নোয়াখালী অঞ্চলে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যকার সীমান্ত হিসেবে কাজ করে। তবে ঘনঘন প্রবাহপথ পরিবর্তনের জন্য এই নদী দুই দেশের সীমান্ত সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হয়ে ছিল বহু বছর। সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে উভয়দেশ ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তির ভিত্তিতে নদীর প্রবাহে সীমানা নির্ধারণের পক্ষে একমত পোষণ করে এবং বাংলাদেশ ১৯৪৭ সালের সীমান্ত নির্ধারণী পিলারের ভিত্তিতে অতিরিক্ত ৪৪ একর জমির মালিকানা লাভ করে।
মূলত মুহুরী নদীর উপর জেগে ওঠা ১৪৪ একর মুহুরীর চরের ধান চাষের উপযোগী ফসলি জমির মালিকানার জন্যই দীর্ঘদিন উভয় দেশের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা বিরাজমান ছিল। ২০১১ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বাংলাদেশ সফরে এই সীমান্ত সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয় এবং উভয় দেশ সীমান্ত চিহ্নিতকরণে সম্মত হয়।
মনু নদী
মনু নদী বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায় প্রবাহিত। নদীটির বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ৮৮ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১১১ মিটার এবং সর্পিলাকারের। কথিত আছে হিন্দুশাস্ত্রকার মনু এ নদীর তীরে শিবপুজা করতো বলে এ নদীর নাম হয়েছে মনু। নদীটির রেলসেতু অঞ্চলে প্রস্থ ২০০ মিটার। অববাহিকার আয়তন ৫০০ বর্গকিলোমিটার। নদীটির জলপ্রবাহ সারাবছরই থাকে। মনু নদী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি এলাকা থেকে উৎপত্তি লাভ করে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে জেলার বিভিন্ন স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুশিয়ারা নদীতে পতিত হয়েছে।
পুরো মৌলভীবাজার ও শহরকে বন্যার কবল থেকে রক্ষায় ৯৯৬ কোটি টাকার মনু নদী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে ২০২০ সালে যা শেষ হবে ২০২৩ এ। মনু নদীর ৭৪ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে ঘুরেফিরে ৬৭টি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। দুই বছরে কাজ হয়েছে মাত্র ২৩ শতাংশ।
আনন্দবাজার/শহক