চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি তিনশ টাকা করার দাবিতে দীর্ঘ ১৭ দিন ধরে আন্দোলন চললেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। চা সংসদের চেয়ারম্যান, নেতা, সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের তৎপরতাও সমস্যা সমাধানে প্রভাব ফেলেনি। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম জাতীয় সংসদের উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ।
গত ২১ আগস্ট দৈনিক আনন্দবাজারে ‘দাসেরে রেখ মনে’ এবং পরদিন ২২ আগস্ট ‘বিশ্বাস ভঙ্গের ১৮২ বছর’ শিরোনামে প্রতিবেদনগুলোতে এই সমস্যার একমাত্র সমাধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কথাই বলা হয়েছিল। শেষ অবধি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার বিকেল ৪টায় গণভবনে চা-বাগান মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন। এই বৈঠকের মাধ্যমেই চা-শিল্পখাতে অচলাবস্থার নিরসন হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
দৈনিক মজুরি তিনশ টাকার দাবিতে গত ৮ আগস্ট থেকে চার দিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি করেন চা-শ্রমিকরা। এরপর তারা ১৩ আগস্ট থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেন। এর মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হলেও তা সমাধান হয়নি। এরই মধ্যে তারা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন।
এরপর ২০ আগস্ট বিকেলে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, বাগান মালিক প্রতিনিধি ও চা-শ্রমিক নেতাদের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠকে তাদের দৈনিক মজুরি ১৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এরপর আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন চা-শ্রমিক নেতারা। তবে সন্ধ্যার পর ফের তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
পেটে ভাত নেই, প্রধানমন্ত্রী এখন ভরসা
দৈনিক তিনশ টাকা মজুরির দাবিতে সারাদেশের ন্যায় হবিগঞ্জে ২৪টি চা-বাগানে কর্মবিরতি অব্যাহত থাকায় শ্রমিকদের পরিবারে অভাব-অনটন দেখা দিয়েছে। বেতন ও রেশন বন্ধ থাকায় খুব কষ্ট করে দিনাতিপাত করছেন তারা। দীর্ঘ এ আন্দোলনের অবসান হবে কি-না, জানেন না শ্রমিকরা। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এখন তাদের একমাত্র ভরসা বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা।
এদিকে, শ্রমিকদের এ আন্দোলন অব্যাহত থাকায় অনেক পরিবারের দেখা দিয়েছে অভাব-অনটন। কর্তৃপক্ষের দেয়া রেশন ও একমাত্র রোজগারটি বন্ধ হয়ে পড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেক শ্রমিক। ঘরে খাবার না থাকায় অনাহারে-অর্ধহারে দিন পার করছেন তারা। অনেক পরিবার সন্তানদের নিয়মিত দু’মুঠো ভাত খেতে দিতে পারলেও বড়রা মাড় (ভাতের সর) খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ‘তবে যারা খুবই অসহায়, একেবারেই চলতে পারছে না, তাদেরকে পঞ্চায়েত কমিটির ফান্ড থেকে সহযোগিতা করার বিষয়ে আলোচনা চলছে বলে জানান শ্রমিকরা।
শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপকালে দৈনিক আনন্দবাজারকে তারা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এখন তাদের একমাত্র ভরসা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আজকের (শনিবার) বৈঠকের মাধ্যমেই এ আন্দোলনের সমাধান হবে বলে আশা করছেন তারা। তবে ওই বৈঠকে কোনো সমাধান না হলে অভাব থাকলেও মাঠে থাকবেন তারা। না খেয়ে থাকলেও আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
চুনারুঘাটের দেউন্দি চা-বাগানের নারী শ্রমিক অনিতা মুড়া। বাগানের ভেতর উত্তরপাড়ায় ৮ সদস্যের পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। বাগানের এ রোজগার দিয়েই চলে সদস্যদের ভরণপোষণ। তবে বাগানে ধর্মঘট শুরুর পর থেকেই রোজগার বন্ধ যায় অনিতা মুড়ার। জমানো টাকা দিয়ে কয়েকদিন কোনোমতে চলেছেন। এখন হাতে টাকা পয়সা নেই। তাই বাজার থেকে সদাইপাতি কেনা দূরের কথা চুলায় একবার আগুন দিলেও দ্বিতীয়বার আগুন জ্বালানোর কথা চিন্তাও করতে পারছেন না তিনি। আর তাই রঙ চা আর রুটি খেয়েই কোনো মতে পরিবার নিয়ে জীবন চালাচ্ছেন এই নারী শ্রমিক।
অনিতা মুড়ার ঘরের অবস্থা খুবই নাজুক। একঘরে সব সদস্যদের নিয়ে কোনো মতে থাকেন তিনি। অনিতা মুড়া বলেন, ‘শত কষ্ট শয্য করে শ্রমিকদের স্বার্থে এবং একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য খেয়ে না খেয়ে হলেও ধর্মঘটে অংশ নিয়েছি’।
চুনারুঘাটের বেগমখান চা বাগানের শ্রমিক মণি সাধু বলেন, ‘১৮ দিন ধরে কাজ বন্ধ। আন্দোলনের কারণে আমরা কাজে যাই না। কাজে না যাওয়ায় মজুরি পাই না, রেশনও বন্ধ। প্রতিদিন বাচ্চা-কাচ্চারে দুইটা ভাত রান্না করে দেই, আর নিজেরা মাড় খেয়ে দিন কাটাচ্ছি’। ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে আছি’।
একই বাগানের সুমি বাগতি বলেন, ‘৫ বছর আগে স্বামীকে হারিয়ে দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে এই বাগানের আয় দিয়েই সংসার চালাচ্ছি। ১৮ দিন ধরে চা বাগানে কাজ না করায় পাচ্ছেন না চলতি সপ্তাহের মজুরি ও রেশন। ঘরে একদিনের খাবারও নেই’। তাছাড়া দোকান থেকে বাকিতেও জিনিস পাচ্ছি না। গ্রামের ওই মাথায় এক বাড়ি থেকে সকালে দুই মুঠো চাল ধার করে এনে রান্না করেছি। রাতে কী রান্না হবে এখন সেই চিন্তায় আছি’।
বাগানের রায়পাড়ার বাসিন্দা গৌরি কর্মকার জানান, ‘শুধু অনিতা মুড়া আর সুমি বাগতি নয়, সব শ্রমিকের ঘরে খাবার সংকট দেখা রয়েছে। তাদের পাশে দাড়াতে কেউ এগিয়ে আসছে না। তারা অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেমেছেন। কষ্ট হচ্ছে, তবুও ধর্মঘট চালাবেন তারা। তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আপোষ নেই। ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরি দিতেই হবে’।
চলমান আন্দোলনে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানকে দৈনিক আনন্দবাজার থেকে একাধিকবার মোবাইল করেও পাওয়া যায়নি। এমনকি বাংলাদেশ চা সংসদের চেয়ারম্যান শাহ আলম ও নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও পাওয়া যায়নি। সিলেট শাখার চেয়ারম্যান জি এম শিবলী ও চট্টগ্রামে ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমকেও পাওয়া যায়নি। শুধু মির্জা সালমান ইস্পাহানির মোবাইলে ফোন করলেও তিনি ধরে পরিচয় শুনে লাইন কেটে দেন।
চা-শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবি আদায়ে রাজনীতিবিদ ও দলের এগিয়ে আসা লক্ষ্য করা যায়নি। এমনকি প্রশাসনও মালিকদের বাগে আনতে পারেনি। এ ব্যাপারে দৈনিক আনন্দবাজারকে জাতীয় সংসদের উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহিদ বলেন, এইভাবে ব্যাখা করার সুযোগ হয়তো নেই। কেননা প্রধানমন্ত্রী যখন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল আমি তখন এই সমস্যার সঠিক সমাধান বের করতে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারা মেনে নিয়েছে। পরে আবার কারা বিভ্রান্ত করেছে। তখন সেই বিষয় থেকে তারা সরে এসেছে।
আব্দুস শহিদ বলেন, আমি চাই শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার। শুধু মুনাফা করলে তো হবে না শিল্প টিকিয়ে রাখে শ্রমিকরা। তাদের ভালো-মন্দ দেখতে হবে। এখন পরিস্থিতি আর স্বাভাবিক নেই। প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতেই হচ্ছে। যদিও তিনি শুরু থেকেই বিষয়টি সুরাহা করতে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। প্রশাসনকে বলেছিলেন হয়নি। বঙ্গবন্ধু চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে প্রচেষ্টা করেছেন। তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চা-শ্রমিকদের জীবনযাত্রা সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে কাজ করে যাচ্ছেন। আশা করি ভালো একটি সমাধান আসবে। সবাই উপকৃত হবে।