ঢাকা | মঙ্গলবার
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিশ্বাস ভঙ্গের ১৮২ বছর

বিশ্বাস ভঙ্গের ১৮২ বছর

ইংরেজদের চায়ের নেশা তাজা রাখতে ভারতবর্ষের বিহার, ওড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে সুখ, শান্তি সমৃদ্ধির প্রলোভন দেখিয়ে কাজে নিয়ে আসা হয়েছিল নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষদের। বলা হয়েছিল কাজ করলে দারিদ্র্য ঘুচবে। ১৮৪০ সালে জীবিকার প্রয়োজনে, সরল বিশ্বাসে পাহাড়ি এলাকায় পাড়ি জমায় তারা। সেই থেকে চা শ্রমিকদের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করা হচ্ছে। আশ্বাসের পর আশ্বাস দিলেও তাদের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে গত ৮ আগস্ট থেকে আন্দোলন করছেন দেশের বিভিন্নস্থানের প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার চা-শ্রমিক। আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও। চলমান আন্দোলনে গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা বলে মজুরি ৩০০ টাকার বদলে ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১২০ টাকা থেকে ১৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ নিয়ে তৈরি হয় ধূম্রজাল। শ্রমিকরা মাত্র ২৫ টাকা বৃদ্ধিকে মানছেন না।

শ্রমিকদের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর কথা বলে তাদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে। তারা চান প্রধানমন্ত্রী নিজ থেকে ঘোষণা দিক। শ্রমিকদের সঙ্গে বসে ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ করুক। কেননা মালিক ও প্রশাসনের কথা নিয়ে নানান ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।

এর আগে গত শনিবার বিকেলে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, বাগান মালিক প্রতিনিধি ও চা শ্রমিক নেতাদের মধ্যে বৈঠকে দৈনিক মজুরি ১৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ সময় আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন চা-শ্রমিক নেতারা। তবে বেঁকে বসেন শ্রমিকরা। সন্ধ্যার পর ফের তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

এ বিষয়ে চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, আমি তো শ্রমিকদের বাইরে যেতে পারবো না। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ রাখতে তখন আন্দোলন স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছিলাম। কিন্তু শ্রমিকরা না মানার কারণে আবারো আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছি।

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমাদের শনিবার জানানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী ২৫ টাকা মজুরি বাড়িয়ে ১৪৫ টাকার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ভারত থেকে এসে চা-শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। আমরা সেই আশ্বাসে বসলেও শ্রমিকরা এই মজুরি মেনে নিচ্ছে না। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে আন্দোলনে থাকতে হচ্ছে।

রাজু গোয়ালা বলেন, আমরা শুধু প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছি যে, তোমরা কাজে যোগ দাও তাহলেই আন্দোলন স্থগিত করে কাজে যোগ দেবো। পরে তিনি দেশে এসে আমাদের সঙ্গে বসুন।

কেশব কৃষ্ণ নামের এক শিক্ষার্থী দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে দ্বিমুখী আচরণ করা হয়েছে। কেননা ২০১৭ সালে বর্তমান সংসদের উপাধ্যক্ষ চা-শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫০০ টাকা দাবি করেছিলেন। আর সেই তিনিই কি করে মাত্র ২৫ টাকা বাড়ানোকে সমর্থন করেন? এটি চা শ্রমিকদের সঙ্গে প্রহসন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। জীবন ধারণের জন্য তিনি ন্যায্য ও বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্ত দেবেন এটিই প্রত্যাশা।

নাম গোপন রাখার শর্তে এ শ্রমিক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কথা বলে চা শ্রমিকদের আন্দোলনে মিথ্যাচার করা হয়েছে। আমাদের একজন যুবনেতাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে ও পুলিশ দিয়ে জোরপূর্বক অন্যকক্ষে নিয়ে আটকে রেখেছে। নেতাদের ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকার মজুরিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছে। আমরা এই মজুরি মানি না।

সেই ১৯৪০ থেকে বর্তমান ২০২২ সাল এই দীর্ঘ ১৮২ বছর ধরে শুধু মিথ্যা আশ্বাস আর অধিকার বঞ্চিতই হচ্ছি। আমাদের পূর্বপূরুষদের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধময় জীবনের আশ্বাসে দিয়ে ইংরেজ সরকার তৎকালীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এখানে এনেছে। সেই সুখ-শান্তি এখনো কৃতদাসের শিকলেই বন্দি হয়ে আছে। এখন আর কত আন্দোলন। ন্যায্য দাবি আদায় না হলে আমরা ঘরে ফিরবো না। প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকেই কথা শুনতে চাই। তিনি ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে বসুক। আপাতত টিভি বা রেডিওতে ঘোষণা দিক আমাদের সঙ্গে বসার। তবেই আন্দোলন থামবে।

এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের উপাধ্যক্ষ মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. আব্দুস শহীদ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমি চা-শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। ২০১৭ সালে ও গত বাজেট বক্তৃতাতেও তাদের মজুরি ৫০০ টাকা করতে সংসদে দাবি জানিয়েছি।

প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে ২৫ টাকা মজুরি বাড়ানো হয়েছে বলে চা শ্রমিকরা অভিযোগ করেছে এ প্রশ্নের জবাবে মো. আব্দুস শহীদ বলেন, আমি নিজ থেকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এমন আশ্বাস দিতে পারি না। প্রধানমন্ত্রীর সচিব তফাজ্জল হোসেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। সেটি নেতাদের দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আবার তফাজ্জল হোসেনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। তিনি তাদের ধন্যবাদ জানান এবং ভারত সফর শেষে চা শ্রমিকদের সঙ্গে বসবেন বলে জানিয়েছেন। এতে আন্দোলনরত নেতারা সম্মত হয়েছে। এখন বিভ্রান্তি ছাড়ানো হচ্ছে আমাদের নামে।

উপাধ্যক্ষ বলেন, চা শ্রমিকদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার জন্য ৪২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় করে দিয়েছি। অনেকের চাকরি হয়েছে। বিয়ে হয়েছে। চা শ্রমিকদের অনেকেই কেজোওয়াল ভিত্তিতে, কেউ কেউ রেজিস্ট্রি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। আবার অনেকে নগদেই কাজ করে থাকে। তাতে তাদের ৫০০ হতে ৭০০ টাকা মজুরি পড়ে।

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল শ্রম দপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম বলেন, শ্রম আইনের ২০৯ ধারা অনুযায়ী শুধু রেজিস্ট্রারভুক্ত সংগঠনই নিজেদের দাবি উত্থাপন ও বাস্তবায়নের অধিকার রাখে। আমরা মালিক ও শ্রমিকপক্ষকে সরকারের পক্ষ থেকে সমন্বয় করতে পারি। মালিকদের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়েছি। তাদের ন্যায্য অধিকার যাতে পায় সে বিষয়ে কথা বলেছি। আর আমরা কারো প্রতি শক্তি প্রদর্শন করতে পারি না। এমনকি করিওনি। একটি ছেলেকে আটকে রাখার যে অভিযোগ, সেটি তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।

এ বিষয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ চা সংসদের সদস্য একাধিকবার মির্জা সালমান ইস্পাহানি, বাংলাদেশ চা সংসদের সিলেট ব্রাঞ্চের সভাপতি জি এম শিবলীর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তাদের পাওয়া যায়নি।

সংবাদটি শেয়ার করুন