করোনা মহামারির প্রভাব কাটতে না কাটতেই নতুন করে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়তে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। জ্বালানির সঙ্কটের কারণ দেখিয়ে সারাদেশেই এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং দিচ্ছে সরকার। ফলে দিনের বেলায় ক্লাসে গিয়েও গরমের কারণে পড়াশোনা করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।
অন্যদিকে সন্ধ্যার পরেও কয়েক দফায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে ঘরে বসেও ঠিকমতো পড়াশোনায় মন বসাতে পারছে না। এতে করোনাকালে শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছিল তা সহসা কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে উঠেছে। নির্ধারিত সময়ে লোডশেডিং থাকার কথা থাকলেও ঘোষণার চেয়েও বেশি সময় লোডশেডিং হচ্ছে। একদিকে ভাদ্রের গরম অন্যদিকে যোগ হয়েছে লোডশেডিং। ফলে লেখাপড়ার টেবিলে মনোযোগ হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শহরের চেয়ে গ্রামের শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ আরও বেশি।
সারাদেশে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ে দুর্ভোগে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছে না। বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের চূড়ান্ত প্রস্তুতি ব্যাহত হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে অন্যান্য শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতিও। জ্বালানি ভর্তুকি কমাতে সরকার গত ১৯ জুলাই দেশব্যাপী এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং বাস্তবায়ন শুরু করে। বছরের জুন পর্যন্ত শিক্ষাবর্ষের প্রথমার্ধ শেষ। এখন স্কুলপর্যায়ে বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে অনুষ্ঠিত হবে এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা।
এমনিতেই সিলেটের বন্যার প্রভাবে সারাদেশে এসএসসি পরীক্ষার সময়সূচি পিছিয়ে আনা হয়েছে। বছরের শেষের দিকে এসএসসি পরীক্ষায় সময়সূচি প্রকাশ হওয়ায় বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে পরীক্ষার্থীরা। এরপর লোডশেডিংয়ে কবলে পড়ে পড়ার টেবিল ছেড়েছে তারা। আগামী নভেম্বরে এইচএসসি ও সমমানের পাবলিক পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে সেমিস্টার এবং শেষবর্ষের পরীক্ষা। বছরের এই সময়টায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার চাপ বাড়ে। ঠিক এমন সময়ে চলছে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং। ফলে শিক্ষার্থীদের আগাম ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা।
চলতি বছরে যেসব শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে ২০২০ সালে তারা ছিল নবম শ্রেণিতে। পাঠ্য বই হাতে পাওয়ার পর শুরু হয় প্রতিটি বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, মিলাদ মাহফিল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষে মার্চে যখন ক্লাস শুরু হওয়ার কথা, ঠিক তখনই করোনাভাইরাসের কারণে ওই বছরের ১৭ মার্চ থেকে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।
এসব শিক্ষার্থী নবম শ্রেণির ক্লাস বা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেই দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। এরপর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও সপ্তাহে দুদিন ক্লাসের সুযোগ পায় তারা। একমাস ক্লাস হওয়ার পর বার্ষিক মূল্যায়ন (অ্যাসাইনমেন্ট) করতে গিয়ে ক্লাস কার্যক্রম আবারও বন্ধ হয়ে যায়। ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী হওয়ায় চলতি বছরের শুরুতে তাদের ক্লাস ফের বন্ধ হয়ে যায়।
পুরাতন দশম শ্রেণির জায়গাটা দখল করে নেয় নতুন দশম শ্রেণি। ধাপে-ধাপে পরীক্ষা পিছিয়ে ১৯ জুন নির্ধারণ করা হয়। সিলেটের ভয়াবহ বন্যার প্রভাবে পরীক্ষা ফের স্থগিত হয়। গুঞ্জন উঠে অটোপাসের। অবশেষে ১৫ সেপ্টেম্বর পরীক্ষার চূড়ান্ত তারিখ নির্ধারণ হওয়ায় পরীক্ষার্থীরা যখন প্রস্তুতি নিতে পড়ার টেবিলে থাকার কথা ঠিক সেই সময়ে বাগড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে লোডশেডিং।
চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী লিখন, নয়ন, আলিফ, মামুন, তনয়, রুমানা, আফিয়া, মুক্তি ও আন্নাসহ অন্যান্য শিক্ষার্থীরা জানান, করোনার প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমরা নবম-দশম শ্রেণির ক্লাস পাইনি। করোনার পর যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয় তখন সপ্তাহে দুটি করে ক্লাস পেয়েছি। পরীক্ষা আগে যখন আমাদের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়ার সময় যাচ্ছে এই সময়ে লোডশেডিং চরম আকার ধারণ করছে। ফলে আমাদের পড়ালেখার ব্যাঘাত ঘটছে। সন্ধ্যার পর থেকে অন্তত রাত দশটা পর্যন্ত পড়ার সময়টাতে লোডশেডিংমুক্ত রাখার দাবি জানান চলতি বছরের এসব এসএসসি পরীক্ষার্থীরা।
অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার ঘোষণা দিয়ে এক ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের কথা বললেও সত্যিকার অর্থে দিনে রাতে কয়েক দফায় বিদ্যুতের লুকোচুরি চলছে। দিনের বেলায় বিদ্যুৎ না থাকলে স্কুলে গিয়েও শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মন বসাতে পারছে না। লোডশেডিংয়ের কারণে শিক্ষকদেরও ক্লাসে পাঠদান কার্যক্রম চালাতে কষ্ট হচ্ছে। শুধু স্কুলের ক্লাসরুমেই নয় বরং বাসাবাড়িতে সন্ধ্যার পরেও বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে।
অনেক সময়ে দেখা যায়, গভীর রাতেও বিদ্যুতের লুকোচুরি চলছে। সবচেয়ে সমস্যা তৈরি হচ্ছে সন্ধ্যার পরে বিদ্যুৎ চলে গেলে। প্রতিটি পরিবারের শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যার পরে পড়তে বসে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে বিঘ্ন হচ্ছে রাতের পড়ালেখা। বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে লোডশেডিং। এভাবে বিদ্যুতের বিভ্রাট চলতে থাকলে নিশ্চিতভাবেই তারা পড়াশোনায় আরো পিছিয়ে পড়বে।
দেওজান সমাজ কল্যাণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম (রাশেদ), বিন্দুবাসিনী সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহীনুর রহমান, জাঙ্গালিয়া ডা. এফ আর খান উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ খলিলুর রহমান ঘাটাইলের ঝুনকাইল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাসুম মিয়াসহ অধিকাংশ শিক্ষক করোনার পর লোডশেডিংয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতির কথা স্বীকার করে বলেন, প্রকৃতি যেমন শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল লোডশেডিং তেমনি কৃত্রিম প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করছে। লোডশেডিংয়ের কারণে সব শ্রেণির শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতি মারত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। কমপক্ষে রাত দশটা পর্যন্ত লোডশেডিং মুক্ত থাকলে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির ব্যাঘাত ঘটবে না।
শিক্ষাবিদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাটেরিয়ালস সাইন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জিএম শফিউর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার মূল সময়টা হচ্ছে রাত। স্কুল, প্রাইভেট বা বিকেলের খেলাধুলার পর রাতে শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিলে বসে। এই সময়ে লোডশেডিং হলে অবশ্যই পড়ালেখার ক্ষতি হয়। যে কোনো পরীক্ষার্থীর প্রস্তুতি নিতে বিঘ্ন ঘটবে। যেহেতু এসএসসি পরীক্ষা সন্নিকটে সেহেতু সন্ধ্যার পর লোডশেডিং কমিয়ে আনাটা পরীক্ষার্থীর জন্য অতি জরুরি হয়ে পড়েছে।
টাঙ্গাইল জেলা শিক্ষা অফিসার লায়লা খানম জানান, এসএসসি পরীক্ষা সন্নিকটে। এই সময়ে পরীক্ষার্থীদের চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে। পরীক্ষার পূর্বে লোডশেডিং হওয়ায় পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে বিঘ্ন ঘটছে। সন্ধ্যার পর পড়ার সময়ে লোডশেডিং না দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানিয়েছেন বলে জানান এই শিক্ষা কর্মকর্তা।
টাঙ্গাইল পিডিবির সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম জানান, বর্তমানে সারাদেশেই লোডশেডিং হচ্ছে। জ্বালানি সাশ্রয় করতে সরকার এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে কোনো কোনো এলাকায় সন্ধার পর লোডশেডিংয়ের সিডিউল পড়ছে। ফলে ওইসব এলাকায় সাময়িকভাবে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটছে।