রংপুর নগরীতে যানজট নিরসন ও পথচারীদের রাস্তা পারাপারের সুবিধার্থে প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দুটি ফুটওভার ব্রিজ। কিন্তু উদ্বোধনের তিন মাস হলেও এখন পর্যন্ত ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের সুফল দেখছেন না নগরবাসী। সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি ডেকে এনেছে। ব্রিজ দুটি নির্মাণের পর কিছু ব্যবসায়ীর পোয়াবারো হয়েছে। অবৈধ দখলের কারণে আগের চেয়ে সড়কে বেড়েছে যানজট। রাস্তা পারাপারে বেড়েছে ভোগান্তিও।
নগরীর সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের দাবি, ফুটওভার ব্রিজ দুটি নির্মাণে যথাযথ স্থান নির্ধারণ করতে না পারাসহ সিটি করপোরেশনের সঠিক পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। তবে রংপুর সিটি করপোরেশনের (রসিক) মেয়র বলছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে রোড ডিভাইডারের মাঝে ফেন্সিং দিয়ে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা হবে। আর এটা সম্ভব হলে পথচারীরা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে বাধ্য হবেন।
রসিকের প্রকৌশল শাখা সূত্রমতে, রংপুর নগরীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল সড়কে এবং সিটি করপোরেশন ভবনের প্রবেশ ফটকের কাছে অত্যাধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন দুটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিজ দুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা। ব্রিজ দুটির ফাউন্ডেশন কংক্রিট ও পাটাতনসহ অন্যান্য অংশ স্টিলের। মূলত যানজট নিরসন ও পথচারীদের চলাচলের সুবিধার্থে নিজস্ব অর্থায়নে ফুটওভার ব্রিজ দুটি নির্মাণ করেছে সিটি করপোরেশন।
সূত্র আরও জানায়, ফুটওভার ব্রিজের জন্য কাঙ্ক্ষিত জমি না পাওয়াতে বিকল্প স্থান হিসেবে সিটি করপোরেশন ভবনের পাশেই ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এটি পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ মোড়ে নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। এজন্য পুলিশ প্রশাসনের কাছে পাঁচ ফুট জমি চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় বাধ্য হয়ে সিটি করপোরেশন ভবনের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে ব্রিজ দুটির নির্মাণ কাজ শেষ হতো। কিন্তু সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অনুমোদন পেতে প্রায় সাত মাস বিলম্ব হওয়ায় ফুটওভার ব্রিজ দুটির নির্মাণ কাজ পিছিয়ে যায়।
চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল সিটি ভবনের সামনে নির্মিত ফুটওভার ব্রিজটির উদ্বোধন করেন মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। সম্প্রতি টার্মিনাল এলাকার ব্রিজটিও পথচারীদের পারাপারের জন্য খুলে দেওয়া হয়। উদ্বোধনের গত তিন মাসে ফুটওভার ব্রিজ পারাপারে সাধারণ পথচারীদের তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। রাস্তা পারাপারে দুর্ঘটনা এড়াতে ব্রিজ দুটি নির্মাণ করা হলেও সড়কের ডিভাইডার রাখা হয়েছে উন্মুক্ত। কোনো ফেন্সিং না থাকায় পথচারীরা ঝুঁকি নিয়ে ইচ্ছেমতো রাস্তা পারাপার হচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর ব্যস্ততম সিটি বাজার সংলগ্ন সড়কে সব সময় যানজট লেগেই থাকে। ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন যানবাহনের চালক এবং পথচারীদের আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে উদাসীনতার কারণে এই সড়কে থাকা ফুটওভার ব্রিজটি শুধু সৌন্দর্য হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। সিটি বাজার ও সিটি কর্পোরেশনসহ রাস্তার দু’পাশ থেকে মানুষজন বেপরোয়াভাবে পারাপার হচ্ছেন। কোনো বাধ্যবাধকতা বা প্রতিবন্ধকতা না থাকায় কারো মধ্যে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
তবে পথচারী বা সাধারণ মানুষ এই ব্রিজের সুবিধা না নিলেও কিছু ব্যবসায়ী ফুটওভার ব্রিজের নিচে গড়ে তুলেছেন ফলসহ বিভিন্ন পসরার দোকান। আর এতে করে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন ফুটওভার ব্রিজের দুপাশে যানজট, মানুষের জটলা আর রাস্তা পারাপারে বেড়েছে ভোগান্তি।
সিটি বাজারের সামনে কথা হয় নুরুল হুদা নামে এক চাকরিজীবীর সঙ্গে। তিনি খরচের ব্যাগ হাতে নিয়ে ডিভাইডারের ফাঁকফোকর হয়ে রাস্তার ওপারে যাচ্ছিলেন। ক্যামেরায় এ দৃশ্য ধারণ করার চেষ্টা করা হলে ক্ষুব্ধ হন তিনি। পরে সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে নুরুল হুদা বলেন, আমার ছবি তুলে কী হবে? বরং ফুটওভার ব্রিজের ছবি তোলেন। ওই ব্রিজ দিয়ে তো কেউ পারাপার করে না। সবকিছুর একটা সিস্টেম আছে, এখানে সেটা মানা হয়নি। এ কারণে এটি কাজেও আসছে না।
প্রায় দুই ঘণ্টার মতো সিটি বাজারের পাশে জেলা পরিষদ কমিউনিটি সুপার মার্কেট থেকে ফুটওভার ব্রিজে মানুষের পারাপার দেখার চেষ্টা করা হয়। এ সময়ে হাতেগোনা প্রায় ৫০ জনকে ব্রিজের উপরে উঠতে দেখা যায়। যাদের বেশির ভাগই ছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পারাপারের জন্য নয়, তারা উঠেছিল সেলফি তুলতে। দুই ঘণ্টায় এমন দৃশ্য দেখা গেলেও বর্তমানে এটি সেখানকার নিত্যদিনের চিত্র।
ফুটওভার ব্রিজে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলা স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী ফাহিম মুরশেদ বলে, আমরা বন্ধুরা মিলে সুপার মার্কেটে এসেছিলাম। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে শহরের যানজট ক্যামেরাবন্দি করতে ফুটওভার ব্রিজের উপরে উঠেছি। এখান থেকে সেলফি অনেক সুন্দর হয়। আর শহর দেখতে বেশ ভালো লাগে।
ফাহিম মুরশেদ আরও বলে, আমরা বেশির ভাগ সময় রাস্তার ওপর দিয়েই পারাপার হয়ে থাকি। এটা যদি ক্যান্ট পাবলিক স্কুল মোড়ের মতো হতো, অর্থাৎ ডিভাইডারে ফেন্সিং থাকতো, তাহলে সবাই ব্রিজের উপর দিয়েই পারাপার হতো। আমরা চাই নগরীতে এমন আরও ফুটওভার ব্রিজ হোক, তবে সেটা যেন পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়।
নগরীর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিপরীতে টার্মিনাল মৎস্য আড়তের কাছে কথা হয় আহসান হাবিব নামে একজনের সঙ্গে। তিনি উত্তর বাবুখাঁ এলাকায় থাকেন। তরুণ এই সমাজ উন্নয়নকর্মী বলেন, টার্মিনালে সব সময় যানজট থাকবেই। ওইখানে ফুটওভার ব্রিজর নিচে বাস থামিয়ে বেশির ভাগ বাসশ্রমিকেরা যাত্রী ওঠা-নামা করে আসছেন। এতে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম এই মহাসড়ক পারাপারে চরম দুর্ভোগের সঙ্গে ঝুঁকি বাড়ছে। ফুটওভার ব্রিজ আছে কিন্তু মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকায় সেটি কোনো কাজে আসছে না। তাছাড়া ওই সড়কের পুরো ডিভাইডার অরক্ষিত এবং রেলিং নেই। যার কারণে জীবনে ঝুঁকি নিয়েই মানুষজন রাস্তা পারাপার হয়ে আসছে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইভান চৌধুরী বলেন, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষের সচেতনতা বাড়ানো হলে ব্রিজ নির্মাণের সুফল মিলবে। এখন তো ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পারাপার না হয়ে রাস্তার নিচ দিয়ে পারাপার করলে কেউ জরিমানা করছে না। আমাদের ট্রাফিক পুলিশ এ নিয়ে নীরব। যদি পুলিশ এবং সিটি করপোরেশন বিষয়টি নিয়ে তৎপর হয় এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা থেকে কাজ করে, তাহলে চার কোটি টাকা ব্যয়ের সার্থকতা থাকবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, নাগরিক সুবিধার মধ্যে চলাচলের প্রশস্ত রাস্তা, ফুটপাত ও ফুটওভার ব্রিজ থাকলেই হবে না। এসব ব্যবহারের উপযোগীও করতে হবে। কিন্তু আমরা এই নগরীতে ভিন্ন চিত্র দেখছি। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণ, ট্রাফিক সিস্টেম এবং মেট্রোপলিটন পুলিশের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে, তা কিন্তু চোখে পড়ছে না। সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত।
খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ফুটওভার ব্রিজ দুটির মাঝখানের ডিভাইডারে রেলিং বা ফেন্সিং তৈরি করা হবে জানিয়ে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, মানুষ যাতে নিরাপদে এপার থেকে ওপারে পারপার হতে পারে, এজন্য সিটি বাজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। দুটি ব্রিজ নির্মাণে আমাদের চার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু আমরা খেয়াল করছি ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে মানুষ তেমন সচেতন না। কেউ আইন মেনে চলতে চায় না। আমরা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পারাপার হতে অভ্যস্ত। অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটছে। তারপরও ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা পারাপার বন্ধ হচ্ছে না।
মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা আরও বলেন, আমরা এখন পরিকল্পনা নিয়েছি, রাস্তার মাঝের ডিভাইডার বন্ধ করে দেওয়া হবে। ক্যান্ট পাবলিক স্কুলের মোড়ের আদলে এই দুটি ফুটওভার ব্রিজের নিচে বড় বড় করে রেলিং করা হবে। কারণ আমাদের নগরে মানুষের সচেতনতার লেভেলটা অনেক নিচে। যার কারণে সহজে ভালো কাজেও সুফল মিলছে না।
আনন্দবাজার/শহক