দেশের অর্থনীতিতে মূল্যবৃদ্ধির চাপ ক্রমেই বাড়ছে। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পালে নতুন করে হাওয়া দিচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব। এমন পরিস্থিতিতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চলমান ডলার সংকট মোকাবিলায় সরকার বেশ কিছু সময় উপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রেশনিংয়ের মাধ্যমে লোডশেডিং থেকে শুরু করে ব্যয় সাশ্রয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হয়। এমনকি সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্য অর্জনে প্রস্তাব করা ৫-জি নেটওয়ার্কের প্রকল্পও ফিরিয়ে দেওয়া হয় শুধুমাত্র ডলার সাশ্রয়ের জন্য। তবে এত কিছু করার পরও নানা ফাঁক- ফোঁকর আর অজুহাতে থেমে নেই ডলার ব্যয় করে সরকারি কর্মকর্তাদের বিলাসী বিদেশ ভ্রমণ।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে গত ১২ মে যে ডলার সাশ্রয়ে বিদেশ ভ্রমণ সীমিত করতে যে পরিপত্র জারি করা হয় তাতে সকল প্রকার এক্সপোজার ভিজিট/ স্টাডি ট্যুর/ এপিএ ও ইনোভেশনের আওতাভুক্ত ভ্রমণ এবং ওয়ার্কশপ/ সেমিনারে অংশ নেয়াসহ সব ধরনের বৈদেশিক ভ্রমণ বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছিল। তবে সেই পরিপত্র জারির পরও দেখা গেছে বিলাসী বিদেশ ভ্রমণের বহর। বিশেষ করে মিটার কেনার কাজ সরেজমিনে দেখতে ওয়াসার ১১ কর্মকর্তা, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীসহ প্রতিনিধি দলের ইতালি ভ্রমণ, এক্সপোজার ট্যুরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ১২ কর্মকর্তার স্পেন ও মরক্কো ভ্রমণ, জনপ্রশাসন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিদেশে বিলাসী সফরের উদ্যোগের বিষয়গুলো গণমাধ্যমে প্রচার পায়।
তবে এত কিছুর পরেও সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ ঠেকানো যায়নি। এবার আরেকটি বিলাসী ভ্রমণের বিষয় নতুন করে সামনে এসেছে। কৃষি গবেষণার নামে ৫ দেশে যাচ্ছেন ৬০ সরকারি কর্মকর্তার একটি বহর। আর এতে ব্যয় হবে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা। ‘বিনার গবেষণা কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ’ নামের একটি প্রকল্পে এ ধরণের বিদেশ ভ্রমণের আয়োজন করা হয়েছে। প্রশিক্ষণের বিশাল আয়োজন রাখা হয়েছে প্রকল্পটিতে।
সূত্রমতে, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনে প্রশিক্ষণের জন্য তাদের সরকারি ব্যয়ে পাঠানো হবে। তাছাড়া দেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ১৫০ বিজ্ঞানী ও ২৮০ জন কর্মকর্তাকে। প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে মাঠ পর্যায়ের ২ হাজার কৃষি কর্মকর্তা ও দেড় হাজার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে। ১৫ হাজার কৃষক-কৃষাণীর জন্যও থাকবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। আর এসব প্রশিক্ষণের জন্য তাদের পেছনে সরকারের ব্যয় হবে ১২ কোটি ২১ লাখ টাকা। যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। যেখানে শুধু ৬০ জনের বিদেশে প্রশিক্ষণেই ব্যয় হবে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা। আর দেশে ১৮ হাজার ৯৩০ জনের প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকায়।
দেশের এমন আর্থিক পরিস্থিতিতে সরকারের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কেন বিদেশে প্রশিক্ষণের এমন বিশাল আয়োজন- এমন প্রশ্ন ছিল পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এ কে এম ফজলুল হকের কাছে। যদিও এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলতে রাজি হননি সদ্য পরিকল্পনা কমিশনে সচিব পদমর্যাদায় যোগদান করা এ সরকারি কর্মকর্তা। যদিও সরকার অনলাইনে মিটিং করতে সৎসাহিত করছে। পরবর্তীতে দুই পরিকল্পনা কমিশনে গিয়ে প্রকল্পটি অনুমোদনের দায়িত্বে থাকা এ সচিবের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি ব্যস্ততার অজুহাতে।
এদিকে, জলবায়ুর আমূল পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা, ঝড়, খরা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, উচ্চতাপমাত্রা, ফ্লাশবন্যা ইত্যাদির তীব্রতা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই জলবায়ু সহিষ্ণু ও উচ্চফলনশীল ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কৃষি গবেষণা জোরদার করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) আধুনিকানের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় সরকার। গবেষণার যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন ও প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনের জন্য এ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। জিন ব্যাংক সুবিধাসহ ১৪টি কৃষি ভিলেজ স্থাপন করা হবে প্রকল্পটির মাধ্যমে। আর এতে ব্যয় হবে ১৬৪ কোটি টাকা। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নের এ প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে ২০১৭ সালের জুন মাসে।
প্রকল্পটি গ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ক্রমবর্ধমান জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক। তবে গতনুগতিক কৌশলের চেয়ে পারমাণবিক কলাকৌশলের ব্যবহার বিশ্বে বাড়ছে। কেননা, এ পদ্ধতিতে একটি নতুন জাত উদ্ভাবনের জন্য ১২-১৩ বছরের জায়গায় সময় লাগে ৭-৮ বছর। তাছাড়া খাদ্যে কোনো ক্ষতিকর প্রভাবও পড়ে না। তাই পরমাণু প্রযুক্তি ও বায়ো-টেকনোলজির সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রতিকূলতা সহিষ্ণু ও উচ্চফলনশীল জান উদ্ভাবনের জন্য প্রকল্পটি জরুরি ছিল।
প্রকল্পটির প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- বিনা’র প্রধান কার্যালয়ে ৫০০ বর্গমিটার উচ্চ প্রযুক্তির আরজিএ সুবিধা স্থাপন। মর্ডান গ্রিনহাইজ, রেইন আউট শেল্টার ও গ্রোথ চেম্বারসহ প্রয়োজনীয় গবেষণা অবকাঠামো নির্মাণ। ফসলের ২৫টি জাত ও ১৫টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হবে। উদ্ভাবিত জাত ছড়িয়ে দিতে দেশের বিভিন্ন কৃষি অঞ্চলে ১৪টি কৃষি ভিলেজ স্থাপন করা হবে। ২৫ হাজার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে ৭৪২টি কৃষি এলাকায়। দুটি পিকআপ ও ৮টি মটরসাইকেলসহ গবেষণার জন্য ৭ ধরণের যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হবে।
প্রকল্পটি ১৫টি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিনা’র আঞ্চলিক ও উপকেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের আধুনিক গবেষণা সম্পর্কে দক্ষতার অভাব দেখা গেছে। জনগণেরও পারমাণবিক কলাকৌশল নিয়ে সচেতনতার অভাব ওঠে এসেছে। তাছাড়া যন্ত্রপাতির অভাবের কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে।
এদিকে, এটি গবেষণাধর্মী প্রকল্প হওয়ায় আর্থিক বিশ্লেষণ করে এর লাভ-ক্ষতি বিচার করা হয়নি। তবে অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে এটি কর্মসংস্থানে অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাছাড়া অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও এসডিজি লক্ষ্যের সাথেও প্রকল্পটি সঙ্গতিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রকল্প প্রস্তবনায়।
প্রকল্পটির ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সিংগভাগ ব্যয় হবে বিভিন্ন পণ্য ও সেবাক্রয়ে। এ খাতে ব্যয় ধরা আছে মোট ব্যয়ের ৩৬ শতাংশ বা ৫৯ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় হবে গবেষণা যন্ত্রপাতি ক্রয়ে। এখানে ব্যয় হবে ৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের ২১ শতাংশ। গবেষণা সংশ্লিষ্ট স্থাপনা নির্মাণে ব্যয় হবে ১৫ কোটি টাকার বেশি। প্রায় ৯ কোটি টাকা লাগবে কম্পিউটারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ক্রয়ে। দুটি পিকআপ ও ৮ মটরসাইকেল কেনায় বরাদ্দ আছে এক কোটি ৯ লাখ টাকা। তাছাড়া কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় হবে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে মূল্যায়ন করা হয়। মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে আসবাবপত্রসহ ৬ পণ্য ক্রয়ের পরিমাণ হ্রাস করার সিদ্ধান্ত হয়। তাছাড়া যন্ত্রপাতিসহ ৪ ধরণের ব্যয় হ্রাস করা হয়। একই বৈঠকে দুইটি জিপ গাড়ি ক্রয় ও ভ্রমণ প্রস্তাবনা বাদ দেওয়া হয়। এতে প্রকল্প ব্যয় হ্রাস পায় ৩২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। পরবর্তীতে প্রকল্পটি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবে বিধায়, তা অনুমোদনের সুপারিশ করে পরিকল্পনা কমিশন।
উল্লেখ্য, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এডিপিতে কৃষি খাতের সাতটি উপখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৪৯টি প্রকল্প চলমান আছে। বরাদ্দবিহীন আননুমোদিত তালিকায় রয়েছে আরো ৬২টি প্রকল্প। এ অর্থবছরের মধ্যে ২১টি প্রকল্প শেষ হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।
আনন্দবাজার/শহক