ঢাকা | মঙ্গলবার
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শ্রমিক সংকটে মাঠে শিক্ষার্থীরা

শ্রমিক সংকটে মাঠে শিক্ষার্থীরা

ধানের রাজধানীখ্যাত উত্তরের জেলা নওগাঁয় কৃষির সঙ্গে জড়িত শতকরা ৮৫ ভাগ পরিবার। ইরি-বোরো আর আমন মৌসুমে জেলার ঘরে ঘরে শুরু হয় ধান কাটাই আর মাড়াই উৎসব। পরিবারের সব সদস্য মিলে তখন যোগ দেয় কর্মযজ্ঞে। শুধু তাই নয়, ধান লাগানো আর পরিচর্যা কাজেও সমান অংশগ্রহণ দেখা যায়। বিশেষ করে জমি তৈরি থেকে চারা রোপন, পরিচর্যা কাজে মাঠ-ঘাটে চলে দারুণ দাপাদাপি। আর এসব কাজে বাদ থাকে না পরিবারের কিশোর-তরুণ বয়সী শিক্ষার্থীরা। এমনকি স্কুল-কলেজের ক্লাস বাদ দিয়েই তারা পরিবারের সদস্যদের পাশে দাঁড়ায়।

ধান মৌসুমে জেলার প্রতি ঘরে ঘরেই এমন চিত্র দেখা যায়। বছরের লম্বা একটা সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত থেকে মাঠে সময় ব্যয় করে। পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন কাজে সহায়তা করে। এতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অর্ধেকে নেমে আসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। নেতিবাচক ফলাফল হিসেবে অন্যান্য জেলা থেকে পড়ালেখাসহ পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। অভিজ্ঞ মহল বলছেন, তীব্র শ্রমিক সংকটের মুখে শিক্ষার্থীদের কৃষিকাজে সম্পৃক্ত হওয়া পরিবারের ব্যয় সাশ্রয় হয়। তবে পড়ালেখায় যেন ক্ষতি না হয় সেজন্য গ্রীষ্মকালীন ছুটি ধান মৌসুমে করলে ভালো হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, ধানের বীজতলা তৈরি, জমিচাষ, রোপন ও পরিচর্যা নিয়ে নওগাঁর চাষিদের প্রায় সারাবছর ধরেই ব্যস্ত থাকতে হয়। বিশেষ করে সেই ব্যস্ততা কয়েকগুণ বেড়ে যায় বোরো মৌসুমে। এসময় ফসল ঘরে তুলতে সময় খুবই কম থাতে হাতে। দ্রুত ফসল ঘরে না তুললে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা বিপাকে পড়তে হয়। তবে গেল কয়েক বছর ধরে বোরো মৌসুমে শ্রমিক সংকট তীব্র আকার ধারন করেছে। বেশি টাকা দিয়েও এসময় শ্রমিক মেলে না। যে কারণে ফসল ঘরে তোলা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে যান ধান চাষিরা। আর এমন সংকট পরিস্থিতিতেই পরিবারের জন্য অনেকটা আশির্বাদ হয়েই আসে পরিবারের ছোট সদস্য শিক্ষার্থীরা। বড়দের সহায়তা করতে তারা স্কুল-কলেজ ফেলে শ্রম দেয় ফসল ঘরে তুলতে।

স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বোরো বা অন্য ধানের মৌসুমে জেলার প্রায় ৫০-৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের সহায়তা করে। এজন্য তারা বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে। সব মিলিয়ে ধানের মৌসুম ঘিরে প্রায় ৪০-৫০ দিন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারে না শিক্ষার্থীরা। আর এ কারণে তারা পড়ালেখায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল তেমন করা সম্ভব হয় না। এমন পরিস্থিতিতে ধানের রাজধানীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রীষ্মের ছুটি ধান কাটাই মাড়াইয়ের সময়টিতে রাখার জন্য দাবি উঠেছে।

দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা স্থানীয় সাংবাদিক শফিক ছোটন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, কৃষিপ্রধান নওগাঁ জেলার প্রায় প্রতিটি পরিবার কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। ফলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফসল ঘরে তোলার কাজে অংশ নেয়। বিশেষ করে বোরো মৌসুমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫৫ শতাংশে পৌঁছে যায়। যে কারণে জেলার শিক্ষাকার্যক্রম দারুণভাবে ব্যাহত হয়। আর তার প্রভাব গিয়ে পড়ে ফলাফলে।

সাংবাদিক ছোটন মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে গ্রীষ্মকালীন ছুটি দেয়া হয় তা স্থানভেদে বিভিন্ন দিক পর্যালচনা করে দেয়া হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। যেমন নওগাঁ অঞ্চলে বোরো মৌসুমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি দিলে এখানকার শ্রমিক সংকটের যে চাপ তা কমে আসবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিবারও উপকৃত হবে।

এ ব্যাপরে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নওগাঁ জেলা সমন্বয়ক জয়নাল আবেদীন মুকুল দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন যে ছুটি দেওয়া হয় তা ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো উপকারে আসে না। বরং দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। তাই ছুটি যদি ধান কাটাইমাড়াই কর্মযজ্ঞের সময় দেওয়া হয় তবে একদিকে যেমন কৃষক পরিবার উপকৃত হবে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদেরও বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার বাড়বে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, নওগাঁ জেলার উপ-পরিচালক এ কে এম মনজুরে মাওলা বলেন, নওগাঁ দেশের বৃহৎ একটি জেলা। এ জেলার মূল অবকাঠামোই কৃষি। ফলে এ জেলার মানুষের উন্নয়নে অবশ্যই কৃষির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এ কে এম মনজুরে মাওলা বলেন, প্রত্যেকটি কৃষক পরিবারের শিক্ষার্থীরাও কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে মৌসুমের শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফেলে শিক্ষার্থীদের ফসলের মাঠে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এতে পরিবার সাময়িক উপকৃত হলেও দীর্ঘ ক্ষতির মুখে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফর রহমান জানান, কৃষি প্রধান এলাকা হওয়ায় মৌসুমের শুরুতে সত্যি স্কুল-কলেজের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবারকে সহযোগিতা করতে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারে না। এ সময় ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতির হার প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ কমে যায়। এতে পাঠ্যদান খানিকটা ব্যাহত হয়। বিশেষ করে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা সব থেকে বেশি পিছিয়ে থাকছে।

গ্রীষ্মকালীন ছুটি পর্যালোচনার বিষয় নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শিক্ষাকর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, স্থান ভেদে সরকারিভাবে ছুটি পর্যালোচনা করা খুব মুশকিল। তবে এ ব্যাপারে শিক্ষাকর্মকর্তাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। তারা সময় নির্ধারণ করে গ্রীষ্মকালীন ছুটি স্থান ভেদে দিতে পারবে। যদি এ নিয়ম করা যায় তবে এ এলাকার শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। বিদ্যালয়ে উপস্থিতিতেও কোনো প্রভাব পড়বে না।

সংবাদটি শেয়ার করুন