রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ক্রেতা বেশি বিক্রি কম

ক্রেতা বেশি বিক্রি কম

কারওয়ান বাজারের চালের বাজার। এক দোকানে ঢুকতেই চোখে পড়লো চারদিকে সারি সারি বস্তা। এর একটিতে মাথা রেখে গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন দোকানি। দেখে মনে হচ্ছে গরমে কাহিল। গলাটা একটু চড়িয়ে জানতে চাইলাম, ভাই, চালের দাম কতো? কত করে বিক্রি করছেন? দু’বার ডাকার পর দোকানি শুনতে ফেলেন। খানিকটা ক্লান্ত চোখে জানতে চাইলেন, কত কেজি নিবেন? এরপর হাঁক দিয়ে কর্মচারীকে বললেন, এই শরিফ উনাকে চাল দে।

বললাম, না ভাই চাল নিবো না, শুধু দাম জানতে আসছি। কত করে বিক্রি করছেন? এবার দোকানি চরম বিরক্ত হলেন। নিবেনই না, তাহলে দাম জিজ্ঞাসা করলেন কেন। ভাই, বলতে পারবো না। চার্ট দেখে নেন। বলেই নিচ থেকে একটা মূল্য তালিকা লাগিয়ে দিলেন দোকানে।

এতো উত্তেজিত কেন? জানতে চাইলে কাওরানবাজারের বিসমিল্লাহ ট্রেডার্সের পরিচালক বিল্লালের বড় ছেলে আরিফ বলেন, সকাল থেকে একের পর এক দাম বলেই যাচ্ছি। এ পর্যন্ত কতোজন যে এলো আর গেলো, কিন্তু চাল বিক্রি করতে পারছি না। আরিফ আরও জানান, কিছুক্ষণ আগে ম্যাজিস্ট্রেট এসেছিলেন। চালান থেকে শুরু করে সব ধরণের কাগজপত্র খুঁজে বের করে দেখাতে হয়েছে। কাগজ খুঁজতে খুঁজতে ঘাম বের হয়ে গেছে। সবকিছু ঠিকঠাক দেখে জরিমানা ছাড়াই চলে গেছেন ম্যাজিস্ট্রেট। এরপর একের পর এক সাংবাদিক আসছেন দাম জিজ্ঞেস করতে।

কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে আরিফ বললেন, সরকার বাড়িয়েছে তেলের দাম। আর মিল মালিকরা বাড়িয়েছে চালের দাম। মাঝখান থেকে সমস্যায় পড়তে হয়েছে আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীরা।

আরও পড়ুনঃ  নিয়ম নীতির পাত্তা না দিয়েই চলছে প্লাজমা থেরাপি

দোকানে টাঙানো মূল্য তালিকা অনুযায়ী, প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৬৮-৭০ টাকা, আটাইশ ৫৫-৫৮ টাকা, নাজিরশাইল ৭৬-৮০ টাকা, চিনিগুঁড়া পোলাও ১১০-১১৫ টাকা, কালিজিরা পোলাও ১১০-১২০ টাকা, মোটা চাল ৪৫ টাকা, নাজির চাল ৮৮ টাকা, বাসমতি ৮৬-৯০ টাকা, পাইজাম ৫২-৫৪ টাকা এবং কাটারি আতব বিক্রি হচ্ছে ৭৪-৭৮ টাকায়।

বরিশাল রাইস এজেন্সির পরিচালক মো. শফিক দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আগে প্রতিদিন খুচরা চাল বিক্রি করতাম ৫ থেকে ৬ বস্তা। এখন তিন থেকে সাড়ে তিন বস্তা বিক্রি করতে পারি। তবে ক্রেতার সংখ্যা আগের মতোই আছে। আগে ৫-১০ কেজির নিচে চাল কেনার লোকের সংখ্যা তেমন একটা ছিলো না। এখন এই সংখ্যাটা বাড়ছে। সবাই কম কম চাল কিনছেন। যে কারণে ক্রেতা থাকার পরও চাল বিক্রি কম। এখন ক্রেতার পাশাপাশি বাজার যাচাই করার লোক বেশি আসে।

কাওরানবাজারের ফাতেমা রাইস এজেন্সির স্বত্ত্বাধিকারী আল হাসিব বলেন, আগের মতো এখন আর চাল কিনছি না। মিল মালিকরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া পরিবহন ব্যয়ও আগের তুলনায় অনেকটা বেড়েছে। সব মিলিয়ে হিসাবটা জটিল হয়ে যাচ্ছে। মিল মালিকরা আমাদের কাছে চাহিদা চায়, কিন্তু আগের মতো চাহিদা দিচ্ছি না।

আল হাসিব আরও বলেন, এখন ক্রেতার সংখ্যা কিছুটা কম। ৫ কেজি চাল বিক্রি করতে হলে ১০টা কথা বলতে হয় এক একজন ক্রেতার সঙ্গে। আগে ৫ বস্তা চাল বিক্রি করতেও এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো না, এখন এক বস্তায় যতো উত্তর দিতে হয়। কেন দাম বাড়ছে? আপনারা দাম বেশি রাখছেন? আমরা কি না খেয়ে থাকবো?- এমন হাজারো প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে দোকানিদের। আমরাও নিরূপায়। আগে এক লাখ টাকায় যে পরিমাণ লাভ করতে পারতাম এখন সেখানে দেড়লাখ টাকায়ও হচ্ছে না। ব্যবসায় মূলধন বাড়ছে কিন্তু আয় কমছে।

আরও পড়ুনঃ  দেশের  বিভিন্ন স্থানে মৃদু ভূকম্পন

রাজধানীর শ্যামবাজারের আব্দুল বাতেন ট্রেডার্স। দোকানের মালিক কামাল হোসেন জানান, মিনিকেট চালের পাইকারি দাম ছিল বস্তা প্রতি ৩ হাজার ১০০ টাকা। এখন কিনতে হয় ৩ হাজার ৩০০ টাকায়। তাছাড়া পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে। প্রতিবস্তায় বাড়তি পরিবহন ব্যয় গুনতে হয় ১৪ থেকে ১৫ টাকা। এছাড়াও সব ধরনের চাল পাইকারিতে কেজি প্রতি বেড়েছে ৮ টাকা পর্যন্ত। কামাল হোসেন বলেন, যেভাবে দাম বাড়ছে, এখন লাভ করাটা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। লাভের টাকায় দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল এবং কর্মচারীরর মজুরি দিতে দিতে পকেট খালি হয়ে যায়।

শুধু কারওয়ান বাজার কিংবা রাজধানীই নয়, মূলত সারাদেশেই অস্থির চালের বাজার। হাঁসফাঁস অবস্থা ক্রেতা-বিক্রেতা সবার। একসময়ে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ প্রবাদটি বেশ জনপ্রিয় ছিলো। এখন আর সেই পান্তার চাল কিনতেই দিন ফুরায়। নুন কেনার সয়টুকু আর পাওয়া যায় না।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে না বাড়তেই বেড়েছে সব ধরণের চালের দাম। চালের বাজারের অস্থিরতার পেছনে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এমন দাবি খোদ ব্যবসায়ীদের। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবদেনেও উঠে এসেছে সিন্ডিকেটের কথা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

চালের বাজারের অস্থিরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, দেশে চালের কোনো সংকট নেই। চাল যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। অসৎ উদ্দেশ্যে কেউ দাম বাড়ালেই অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। যদি কোনো সিন্ডিকেট এর পেছনে দায়ী থাকে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আরও পড়ুনঃ  ঈদ পর্যন্ত বন্ধ হচ্ছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, চালের কোনো ঘাটতি নেই। আর সরকারও চালের দামও বাড়ায়নি। যারা চালের বাজার অস্থিতিশীল করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন