হঠাৎ করেই বেড়েছে জ্বালাতি তেলের দাম। যার প্রথম প্রভাব পড়েছে গণপরিবহনে। একদিনের ব্যবধানেই বেড়েছে বাস ভাড়া। পন্য পরিবহনেও গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে নিত্যপন্যের বাজারে। একদিনের ব্যবধানে সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। এ যেনো ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। এতে সবার মনেই দেখা দিয়েছে চাপা ক্ষোভ। তারা বলছেন, সরকার সবকিছুর সাথে সমন্বয় করে কিন্তু আমাদের আয়ের সাথে ব্যয়ের সমন্বয় হয় না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ এমনিতেই বাজারে যেতে পারছে না। এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি আরও অসহনীয় করে তুলবে। মধ্যবিত্তরা দিশেহারা হয়ে পড়বে।
হানিফ মাহমুদ। পেশায় বেসরকারি চাকরিজীবী। থাকেন রাজধানীর নিউইস্কাটনে। স্ত্রী, এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে চার জনের সংসার। থাকেন ব্যাচেলর বাসায়। ভাড়া দিতে হয় ৩ হাজার টাকা। খাওয়া বাবদ ৩ হাজার, অফিস যাতায়াত খরচ দেড় হাজার টাকা। এছাড়া ইন্টারনেট ও ময়লা বিলসহ আরো ৪ হাজার টাকা খরচ করতে হয় তাকে। এ নিয়ে মোট ১১ হাজার টাকা খরচ। কিন্তু সর্বসাকুল্যে বেতন পান মাত্র পঁনেরো হাজার টাকা। বাড়িতে সংসার চালানোর জন্য হাতে থাকে মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা। এ টাকায় তিনজনের সংসার কোনোভাবেই চলে না। তার উপরে রয়েছে মা-বাবা। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে তার মাথায় চিন্তার ভাঁজ। এবার বুজি গ্রামের বাড়িতেই ফিরে যেতে হবে?
হানিফ বলেন, আমি চাকরি করে নিয়মিত বেতন পাই। কিন্তু প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সংসার চালাতে পারছি না। বাজারে সবকিছুর দাম আকাশ চোঁয়া। সবজি, মাছ, মশলাসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম প্রতিদিন বেড়েই চলছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে এখন টিকে থাকাই দ্বায়। মনে হচ্ছে এ শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। গ্রামে গিয়ে কি করবো? কৃষি কাজ করারও উপায় নাই। চাষের জমিও তেমন একটা নাই। সংসার নিয়ে আমি এখন দিশেহারা।
বাংলামটর এলাকায় রিকশা চালান সিদ্দিক মিয়া। তিনি বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রিকশা চালাই। সারাদিন চালিয়ে আয় হয় মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। মাসে প্রতিদিন রিকশা চালানো সম্ভবও হয় না। সবমিলিয়ে মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় হয়। বাসা ভাড়া, খাওয়া বিল, রিকশা ভাড়া মিলিয়ে এখানেই চলে যায় ১০ হাজার টাকা। খুব কষ্টে ২ থেকে তিন হাজার টাকা রাখতে পারি। এই টাকায় বাড়িতে থাকা চারজনের সংসার চলে না। খুব কষ্ট হয় তাদের। শাক-কচুর লতি সংগ্রহ করে ভাতের সাথে খেতে হয়। কোনো রকম সংসার চলছে। এখন সুনলাম তেলের দাম বাড়ছে। এখন সবকিছুর দামই বেড়ে যাবে। মানুষের আয়ও কমবে। এখন তো আর আগের মতো মানুষ রিকশায় চড়বে না। ভাড়াও কমে যাবে। একদিকে আয় কমবে অন্যদিকে সবকিছুর দাম বাড়বে। সংসার আর চলবে বলে মনে হয় না। ঢাকায় থাকাটাই এখন বড় যুদ্ধ।
কাঠালবাগান এলাকায় থাকেন মোস্তফা আহমেদ। কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বেতন পান সবমিলিয়ে ২৫ হাজার টাকা। চার সদস্যের পরিবার তার। বাসা ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে সংসার খরচ, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা, অফিসে যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় দুশ্চিন্তা বেড়েছে মোস্তফার।
তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে অনেক। এখন বাসের ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। খবর পাচ্ছি সয়াবিন তেলের দামও বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। এমনিতেই সবধরণের পন্যের দাম বেড়েছে। সরকার থেকে বলা হচ্ছে বিদ্যুতের দামও নাকি বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে খুব আতংকে দিন কাটাতে হচ্ছে। ভাবতেছি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিবো। কারণ ঢাকায় টিকে থাকা সম্ভব না।
ধানমন্ডি একটি সুপার শপে কাজ করেন আরিফুর রহমান। মাস শেষে বেতন পাই ১৫ হাজার টাকা। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা ও এক ভাই-এক বোন। আয়ের উৎস একমাত্র আমিই। ঢাকায় যত কম খরচ করা যায় তাই করছি। তারপরও মাসে ৯ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। বাড়িতে তেমন একটা টাকা দিতে পারি না। বেতন বাড়বে বাড়বে করেও বাড়ছে না। অথচ হুহু করে সবকিছুর দামই বাড়ছে। সরকার সবকিছু সমন্বয় করে কিন্তু আমাদের আয়ের সাথে ব্যয়ের সমন্বয় হয় না।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, জ্বালানির এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রথমেই ধাক্কা খাবে পরিবহন সেক্টরে। আর পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে সবই সম্পৃক্ত। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। ফলে বাড়বে পণ্যের দামও। সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ এমনিতেই বাজারে যেতে পারছে না। এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এই দাম আরও অসহনীয় করে তুলবে। মধ্যবিত্তরা দিশেহারা হয়ে পড়বে। ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে মানুষ আর ভালো থাকতে পারে না।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, জ্বালাতি তেলের দাম বাড়লে সবকিছুর দাম বাড়বে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক হলো তেলের দাম বাড়ানো। তেলের দাম যে হারে বাড়ে নিত্যপন্যের দাম এর চেয়ে তিন-েচারগুন বাড়ে। বাজারের উপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এখন মানুষ বাঁচবে কিভাবে? তারা তিনবেলার যায়গায় দুইবেলা কেউ কেউ একবেলা খাবে। এতে অপুষ্টিতে ভুগবে মানুষ। বেশিরভাগ মানুষের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিতে হবে। অনেকের বাচ্চাদের পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে হবে। চিকিৎসা খরচ বাঁচাতে হবে। অসুখ হলে তাদেরকে হাসপাতাল ছেড়ে কবিরাজের কাছে যেতে হবে। সবমিলিয়ে দেশে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
আনন্দবাজার/শহক