অল্প পরিশ্রমে স্বল্প পুঁজিতে কম সময়েই অধিক লাভ হওয়ায় রাজবাড়ীতে দিন দিন বাড়ছে ড্রাগন ফলের চাষ। বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হচ্ছেন জেলার ড্রাগন চাষিরা। কৃষিবিদরা বলছেন, নানা পুষ্টিগুনে সমৃদ্ধ ড্রাগন ফলটি সব বয়সের মানুষের জন্য একটি আদর্শ ফল। তাই জেলার অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে ড্রাগন ফলের চাষ। অর্থনৈতিক উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে কৃষকের ভাগ্য। জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে রাজবাড়ীতে এবার ৩০ লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি হবে।
দিন দিন রাজবাড়ীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে ড্রাগন ফলের চাষ। স্বল্প পরিসরে বাগানে, ফসলি জমিতে, এমনকি বাড়ির ছাদে টবে ড্রাগন রোপন করে অর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন এখন অনেকে। রাজবাড়ীতে এ ড্রাগন ফল মানুষের কাছে নতুন। গত ৫ থেকে ৭ বছর ধরে এটি পরিচিতি পাচ্ছে। বিভিন্ন রোগের ঔষুধ হিসেবে কাজ করায় রাজবাড়ীতে প্রায় প্রতিটি বাসা বাড়ির আঙিনায় ও ছাদে ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে ড্রাগন ফল এর চাষ। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই ড্রাগন ফল চাষ করা যায়। শুধুমাত্র একটু পরিচর্যা করলেই ড্রাগন গাছে ফল ধরে তাই অনেক গৃহবধূ ও চাষিরা ড্রাগন ফলের চাষে দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠছে। দেখতে সুন্দর স্বাদে সুস্বাদু ও অধিক পুষ্টিগুণ থাকায় রাজবাড়ী জেলার মানুষের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ড্রাগন ফলের চাষ।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, রাজবাড়ী জেলার ৫টি উপজেলায় বর্তমানে প্রায় ৫০ জন চাষি ৩ হেক্টর জমিতে করছেন ড্রাগন ফলের চাষ। যাতে চলতি মৌসুমে উৎপাদিত হবে প্রায় ১০ টন ড্রাগন ফল। অর্থের হিসেবে যা প্রায় ৩০ লাখ টাকা।
রাজবড়ী জেলা সদরের রূপপুর গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী কৃষক গফুর কাজী। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তিনি কৃষি কাজের সঙ্গেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। গত ৭ বছর আগে ২০১৫ সালে কৃষি বিভাগে একটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ড্রাগন ফল সম্পর্কে জানতে পারেন। তারপর ১০ শতাংশ জমিতে ড্রাগন চাষে একটি প্রদর্শনী বাগান শুরু করেন। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ড্রাগন চাষি গফুর কাজীকে। প্রথম বছরেই ৪০টি গাছে ধরে ফল। পরের বছর দেড় লাখ টাকার ফল বিক্রি করেন তিনি। এভাবেই অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল হয়েছেন। এখন প্রতি বছর প্রায় দেড় থেকে ২ লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি হয় তার।
কৃষক গফুর কাজী বলেন, আমি দীর্ঘদিন কৃষিকাজ করি। ধান, পাট, গম, পেঁয়াজ, রসুন, শাক সবজিসহ সব ধরনের ফসলের আবাদ করেছি। ৭ বছর আগে কৃষি অফিসে একটি প্রশিক্ষণে ড্রাগন ফলর কথা জানতে পেরে চাষের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করি। পরে কৃষি অফিস থেকে ১০ শতাংশ জমিতে ৪০টি চারা দিয়ে একটি প্রদর্শনী প্লট পাই। সেখান থেকেই ড্রাগন চাষ শুরু। এরপর আর ড্রাগন চাষে লোকসান হয়নি। ভালো লাভ হয়েছে। প্রতিবছর প্রায় দেড় লাখটাকার মত ড্রাগন বিক্রি করছি। কৃষি কাজ করেই আমি বাড়ি তৈরী করেছি। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শিখেয়েছি।
কৃষাণী সাহেরা বেগম বলেন, ড্রাগন ফল চাষ লাভজনক। আমরা স্বামী স্ত্রী দুইজনে মিলে এখন ড্রাগন বাগানে কাজ করি। বাজারের ফল ব্যবসায়ীরা বাড়ি এসে ড্রাগন কিনে নিয়ে যায়। প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দরে দাম দেয়।
জেলা শহরের ১নং বেড়াডাঙ্গা সড়কের বাসিন্দা আল আমিন বলেন, চাকরির পাশাপাশি শখের বসে বাড়ির ছাদে ড্রামে ড্রাগন ফলের চারা রোপন করেছি। আমি নিজেই ড্রাগন ফল খেয়েছি। ফলটি খেতে অনেক সুস্বাদু ও মজাদার। ইন্টারনেটে দেখেছি ড্রাগনে নানাবিধ পুষ্টিগুণ রয়েছে।
রাজবাড়ী সদর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ বাহাউদ্দিস শেখ বলেন, ড্রাগন ফল এটি এক প্রজাতির ফল, একধরনের ফণীমনসা প্রজাতির ফল। এ ফল মূলত ড্রাগন ফল হিসেবে পরিচিত। গণচীন এর লোকেরা এটিকে আগুনে ড্রাগন ফল এবং ড্রাগন মুক্তার ফল বলে। ভিয়েতনামে মিষ্টি ড্রাগন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে ড্রাগন ফল, থাইল্যান্ডে ড্রাগন স্ফটিক নামে পরিচিত। ড্রাগন ফলের গাছ দেখতে একদম ক্যাকটাসের মতো। পাতাবিহীন এ গাছটি দেখে অনেকেই একে ক্যাকটাস বলেই মনে করেন। ডিম্বাকৃতির উজ্জ্বল গোলাপি রঙের এ ফলের বর্তমানে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ২০১১ সালে রাজবাড়ী হর্টিকালচার সেন্টারে পরীক্ষামূলকভাবে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে ড্রাগন চাষের জন্য প্রয়োজন দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। বছরে একটি ড্রাগন গাছ থেকে প্রায় ১৪০টি ফল পাওয়া যায়। এসব ফল স্থানীয় বাজারে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়ে থাকে। তিনি আরও বলেন, অল্প পরিশ্রমে স্বল্প পুঁজিতে কম সময়েই অধিক লাভ হওয়ায় রাজবাড়ীতে দিন দিন বাড়ছে ড্রাগন ফলের চাষ। বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হচ্ছেন জেলার ড্রাগন চাষিরা। নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ড্রাগন ফলটি সব বয়সের মানুষের জন্য একটি আদর্শ ফল। তাই জেলার অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে ড্রাগন ফলের চাষ। এতে বদলে যাচ্ছে কৃষকদের ভাগ্য।
রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক এস এম সহীদ নূর আকবর জানান, গত ১ যুগ ধরে বাংলাদেশে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু হলেও রাজবাড়ীতে এর চাষাবাদ শুরু হয়েছে বছর ৭ আগে। তবে অর্থকারী ও পুষ্টিকর এ ফলের চাষ দিন দিন আরও বাড়াতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে চাষিদের নানাবিধ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। বারী ড্রাগন ১, কিংক রোজ, রেড ভেলভেট জাতের ড্রাগনের চাষ হচ্ছে। এ চাষ বেশ লাভবান চাষাবাদ। ড্রাগন গাছে একটানা ৫ থেকে ৬ মাস ফল পাওয়া যায়। অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এ ফল চোখকে সুস্থ্য রাখে, রক্তের কোলেস্টেরল কমায়, উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের রোগসহ নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। রাজবাড়ী জেলার মাটি ড্রাগন চাষের উপযোগী।