ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ খাদ্যগুদামে সরকারি চাল সংগ্রহের নামে মিল মালিকদের কাছ থেকে কমিশন নিয়ে বিবর্ণ চাল নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। সরকারিভাবে বিবর্ণ চাল নেয়ার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তাতে কান না দিয়ে দেদারসে নিচ্ছেন এই চাল। চলতি বোরো মৌসুমে আশুগঞ্জের ১৮৫টি মিল মালিকের কাছ থেকে ২৯ হাজার ৫৭০ মেট্রিক টন বোরো চাল সংগ্রহ করবে সরকার। এই চাল সংগ্রহে প্রতি কেজিতে ৫৭ পয়সা করে দেড় কোটি টাকারও বেশি কমিশন আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কমিশনের মাধ্যমে গুদাম কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে নিম্নমান ও বিবর্ণ চাল গুদামে সরবরাহ করছেন মিল মালিকরা। সরেজমিনে গিয়ে ঘটনার সত্যতা মিলেছে। চাল দিয়ে গুদাম থেকে নেয়া চেক ব্যাংক থেকে পাস হলেই সঙ্গে সঙ্গে গুদাম কর্তৃপক্ষ ও হাসকিং মিল মালিকদের এই কমিশনের টাকা দিয়ে দিতে হয়। এ ছাড়া মিল চুক্তি ও মিলের লাইসেন্স নবায়ন করার জন্যও প্রতি মিল থেকে উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে আশুগঞ্জ খাদ্য গুদাম কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এই টাকা জেলাসহ উর্ধ্বতন বিভিন্ন দপ্তরেও বণ্টন হয়। এদিকে চাল নেয়ার ধীরগতির কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ারও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
সরেজমিনে আশুগঞ্জ খাদ্যগুদাম এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গুদামের সামনে ছয়টি ট্রাক সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে চাল দেয়ার জন্য। গুদামের মুখে দুটি, পাশে একটি ট্রাক থেকে দুর্গাপুর রাইস মিলের নামে সিদ্ধ চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে। অন্যটিতে রজনীগন্ধা রাইস মিলের নামে আতপ চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে। এরমধ্যে দুর্গাপুর রাইস মিলের কাছ থেকে সংগ্রহ করা চাল অনেকটাই বিবর্ণ অবস্থায় রয়েছে। চালের বস্তাপ্রতি পরীক্ষা করার জন্য আশুগঞ্জ খাদ্য গুদামের এএসআই আকতার হোসেন দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে বিবর্ণ এই চাল দেখেও গুদামে সংরক্ষণ করছেন।
বিবর্ণ দানার পরিমাণ সরকারিভাবে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ থাকার কথা থাকলেও সাংবাদিকদের সামনে গত বুধবার দুপুরে এই বিবর্ণ চাল গুদামে সংরক্ষণ করা হয়েছে। চাল পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা আশুগঞ্জ খাদ্য গুদামের এএসআই আকতার হোসেন বলেন, দেখে শুনেই এই চাল নিচ্ছি। এই বিবর্ণ চাল নেয়া যায়। এতে কোনো সমস্যা নাই। তবে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. জাকারিয়া মুস্তফা এই চাল নিতে সরকারের কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বলে জানানন।
খাদ্যগুদাম সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারিভাবে আশুগঞ্জ খাদ্যগুদাম থেকে মোট ২৯ হাজার ৫৭০ টন বোরো চাল সংগ্রহ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সিদ্ধ চাল ৪০ টাকা কেজি দরে ২২ হাজার ৮৯০ টন এবং ৩৯ টাকা কেজি দরে আতপ চাল ৬ হাজার ৬৮০ টন। গত ২৭ জুলাই পর্যন্ত মোট ১৩ হাজার ৩৪০ টন সিদ্ধ ও ৫ হাজার ৪৪৮ টন আতপ চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া ২৭ টাকা কেজি দরে ৫৭৭ টন বোরো ধান সংগ্রহ করা হবে এই খাদ্য গুদামের অধীনে।
এর মধ্যে গত ২৭ জুলাই পর্যন্ত মাত্র ৬৫ টন বোরো ধান সংগ্রহ করা হয়েছে কৃষকদের কাছ থেকে। আশুগঞ্জ খাদ্যগুদামে বোরো মৌসুমের চাল সরকারিভাবে সংগ্রহ শুরু হয়েছে চলতি বছরের ১৬ মে থেকে। যদিও বিভিন্ন এলাকায় ৭ মে চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। আশুগঞ্জ খাদ্যগুদামের অধীনে এখানকার ১৮৫টি রাইসমিল থেকে এই চাল সংগ্রহ করার কথা রয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি ড্রায়ার রয়েছে। সরকারি আগের মূল্য প্রতি কেজি ৩৩ টাকা থাকলেও ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে চলতি বোরো মৌসুমে এই চালের মূল্য বাড়িয়ে আতপ ৩৯ টাকা ও সিদ্ধ ৪০ টাকা করা হয়েছে।
তবে আশুগঞ্জ খাদ্য গুদাম কর্তৃপক্ষ স্থানীয় মিল মালিকদের সঙ্গে সখ্যতা করে কেজি প্রতি ৫৭ পয়সা কমিশন নিয়ে সরকার নিষিদ্ধ নিম্নমানের বিবর্ণ চাল গুদামে সংরক্ষণ করছেন। মিল মালিক ও গুদাম কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেট করে এই কমিশনের টাকা সংগ্রহ করছেন। বিষয়টি অনেকটাই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চাল সংগ্রহ অভিযান চালায় আশুগঞ্জ খাদ্য গুদাম।
সিন্ডিকেটে উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা ও মিলের নামও রয়েছে। কেউ টাকা না দিলে তাদের চাল ফেরত যাচ্ছে গুদাম থেকে। ভয়ের কারণে এসব সিন্ডিকেটের ব্যাপারে মুখ খোলার সাহস পান না কেউ। বিষয়টি নিয়ে দেশের একটি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করে এসব অভিযোগের সত্যতা পায়। পরে ১০-১৫টি মিলের লাইসেন্স বাতিলসহ ভালো চাল সংগ্রহ, কমিশন বাণিজ্য বন্ধ এবং দোষী মিল মালিক ও খাদ্য গুদামের অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে। এরই জের ধরে আশুগঞ্জ উপজেলা সাবেক খাদ্য কর্মকর্তা আবদুস সালাম ও খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন পাটোয়ারীকে অন্যত্র বদলি করা হলেও অভিযুক্ত মিল মালিক কিংবা মিলগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি খাদ্য মন্ত্রণালয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, প্রতি কেজি চাল সরবরাহ করতে বর্তমানে ৫৭ পয়সা করে কমিশন দিতে হয় চাল সরবরাহকারীদের। কমিশনের অর্থ আশুগঞ্জ উপজেলাসহ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পকেটে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে জেলা ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কোনো কর্মকর্তা পরিদর্শনে এলেও তাদের এই কমিশনের টাকা দিতে হয়। যার কারণে বাধ্য হয়েই এই কমিশন নেয়া ও দেয়া লাগে।
চলতি বোরো মৌসুমে আশুগঞ্জের ১৮৫টি মিল মালিকদের কাছ থেকে ২৯ হাজার ৫৭০ টন বোরো চাল সংগ্রহ করবে সরকার। এই চাল সংগ্রহে খাদ্যগুদাম ও মিল মালিকরা প্রতি কেজিতে ৫৭ পয়সা করে এক কোটি ৬৮ লাখ ৫৪ হাজার ৯০০ টাকা আদায় করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কয়েকজন মিল মালিক জানান, খাদ্য গুদামের নিয়ম অনুযায়ী আমাদের চলতে হয়। কমিশন বাণিজ্যের বিষয়টি সকলেরই জানা। এ নিয়ে লিখলে কোনো কাজ হবে না। এ টাকার ভাগ সবাই পায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা চাতাল কল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম ভূইয়া স্বপন বলেন, কমিশন নেয়া হচ্ছে না। তবে এবার সরকারের দেয়া চালের দাম থেকে বাজারের দাম বেশি হওয়ায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। বিবর্ণ চাল ভুল করে নিয়েছে তারা। এই চাল নেয়ার কথা নয়। খাদ্যগুদাম কর্তৃপক্ষকে আরো সতর্ক হতে হবে। কমিশন দিয়ে আমি কখনো চাল সরবরাহ করিনি। যদি কমিশন নিয়ে থাকে তাহলে অন্যায় করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আশুগঞ্জ খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সুলাইমান মিয়া বলেন, ড্রায়ারের চাল ক্রিম কালারের হয়। গুদামের মজুদ বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করছি। ভালো চাল দেয়ার জন্য অনুরোধ করে যাচ্ছি ব্যবসায়ীদের। কোনো কমিশন নেয়া হচ্ছে না। বিবর্ণ চাল নেয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মো. সুলাইমান মিয়া বলেন, আবহাওয়া খারাপ থাকায় এই চাল বিবর্ণ দেখা যাচ্ছে। কমিশন বাণিজ্য কিংবা নিম্নমানের চাল সংগ্রহের অভিযোগ সত্য নয়।
আশুগঞ্জ খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরো বলেন, অনেক গাড়ির চাল পরীক্ষার পর খারাপ পাওয়া গেলে অর্ধেক ট্রাকসহ চাল ফেরত পাঠানো হয়। ট্রাক থেকে আনলোড করা বাকি অর্ধেক নিম্নমানের চাল গুদামে সংগ্রহের কথা স্বীকার করেন তিনি। গুদামে সংরক্ষণ করা চাল ফেরত দেয়া হয় না কেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি তিনি।
এ ব্যাপারে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. জাকারিয়া মুস্তফা বলেন, বিবর্ণ চাল নেয়ার বিষয়ে সরকারি কঠোর নিষেধাজ্ঞা আছে। এই বিষয়ে কথা বলে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আর কমিশন নেয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। বিবর্ণ চাল ও কমিশন নেয়ার বিষয়টি প্রমাণ হলে আমি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
আনন্দবাজার/শহক