গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রুশবাহিনী। যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ ছিল। এতে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয় চরমভাবে। এর পাশাপাশি রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকে। ফলে বিশ্ব বাজারে খাদ্য ও জ্বালানির দাম ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। দেশে দেশে নিত্যপণ্যের দামে একধরণের অস্থির পরিস্থিতি চলছে। তবে পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার আশা জাগছে।
ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির জন্য কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো খুলে দিতে জাতিসংঘ-সমর্থিত একটি চুক্তি করেছে রাশিয়া ও ইউক্রেন। গত শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত আটটার দিকে ঐতিহাসিক এ চুক্তি সম্পন্ন হয়। এই চুক্তি সইয়ের বিষয়ে তুরস্ক ও জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইউক্রেনে রুশ হামলার পর বিশ্বজুড়ে যে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে, এ চুক্তির ফলে তা কেটে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তুরস্কে অনুষ্ঠিত এ চুক্তির ফলে রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে তাদের অবরোধ শিথিল করবে, যাতে ইউক্রেন থেকে জাহাজে করে খাদ্য রপ্তানি হতে পারে।
তুরস্ক বলছে, এ চুক্তির ফলে শুধু ইউক্রেন নয়, কৃষ্ণসাগর দিয়ে রাশিয়ার খাদ্য রপ্তানিও সহজ হবে। এর চুক্তির ফলে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের গম আমদানির পথ খোলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের গম আমদানির ৬০ শতাংশই আসে এ দুটি দেশ থেকে।
কী আছে চুক্তিতে
কৃষ্ণসাগরের পূর্বপরিকল্পিত পথে পণ্যবাহী জাহাজ যাত্রা করার আগে ইউক্রেনীয় বন্দরগুলোতে শস্য ভর্তির কাজ নিরীক্ষণ করবে তুরস্ক, ইউক্রেন ও জাতিসংঘের কর্মীদের একটি দল। ইউক্রেনের বন্দরগুলোতে পেতে রাখা মাইন এড়াতে ইউক্রেনীয় নাবিকেরা জাহাজ মানচিত্র ব্যবহার করে শস্য পরিবহনকারী বাণিজ্যিক জাহাজগুলো নিয়ে যাবে। জাহাজগুলো কৃষ্ণসাগর অতিক্রম করে তুরস্কের বসফরাস প্রণালির দিকে যাবে। জাতিসংঘ, ইউক্রেন, রাশিয়া ও তুরস্কের প্রতিনিধিরা ইস্তাম্বুলের একটি যৌথ সমন্বয় কেন্দ্র থেকে জাহাজ পর্যবেক্ষণ করবেন। ইউক্রেনে প্রবেশকারী জাহাজগুলোও একইভাবে যৌথ সমন্বয় কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করা হবে, যাতে তারা ইউক্রেনে অস্ত্র বহন করতে না পারে। রাশিয়া ও ইউক্রেন অত্যাবশ্যক শস্য পরিবহন নিযুক্ত কোনো বাণিজ্যিক জাহাজ বা বন্দরগুলোতে আক্রমণ করবে না।
খাদ্যের সংকট কাটবে
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘দুটি যুদ্ধরত দেশের মধ্যে এ ধরনের একটি চুক্তি ঐতিহাসিক। এটি বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে। বিশেষত, আমরা যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছি, তা তিনটি মূল ইউক্রেনীয় বন্দর ওদেসা, চেরনোমর্স্ক ও ইউঝনি থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাণিজ্যিক খাদ্য রপ্তানির পথ খুলে দেবে।’
চুক্তি সই করার আগে কিয়েভের পক্ষ থেকে মস্কোর সঙ্গে সরাসরি কোনো চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া হয়। খাদ্যশস্য রপ্তানি নিয়ে দুই দেশে চুক্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছালেও, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশ বাহিনীর হামলা জোরদার হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে শত্রুতা ও অবিশ্বাস এখনো অনেক গভীর। এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক বলেন, জাতিসংঘের সঙ্গে শস্য রপ্তানি নিয়ে চুক্তি ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে অন্য কোনো নথিতে তারা সই করবেন না। তিনি বলেন, উসকানির ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক সামরিক জবাব দেবে ইউক্রেন।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাস একটি সূত্রের বরাতে জানিয়েছে, চুক্তির অধীনে ইউক্রেনের বৃহত্তম রপ্তানি বন্দর ওদেসাসহ তিনটি বন্দর উন্মুক্ত করা হবে। গত সপ্তাহে কূটনীতিকেরা বলেছিলেন, চুক্তির আওতায় পোতাশ্রয়ে শস্যের চালানগুলো যৌথভাবে তল্লাশি করে দেখা হবে। রাশিয়ার উদ্বেগ, ইউক্রেনে অস্ত্র চোরাচালানের জন্য নৌপথ ব্যবহার হতে পারে। ওদেসা বন্দরে দুই কোটি টন শস্য আটকে রয়েছে। এ ছাড়া রুশ সেনাদের বাধার মুখে বেশ কিছু জাহাজ আটকে রয়েছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেছেন, বর্তমান খাদ্যসংকট দূর করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
রয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্বও
তবে বিশ্বজুড়ে যেভাবে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে, যুদ্ধরত রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে হওয়া চুক্তির ফলে তা যে সহসাই কেটে যাবে এমনটা ভাবতে পারছেন না অনেকে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, প্রধান খাদ্যদ্রব্যের জন্য এ দুই দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকা মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার অনেক দেশে শিগগিরই খাদ্যসংকট মেটার সুযোগ নেই।
কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের শীর্ষ দুই গম রপ্তানিকারক দেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে খাদ্যপণ্যের দাম জানুয়ারি থেকে ১৭ শতাংশ বেড়েছে। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে আছে।
চলতি বছরের এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের কমডিটি মার্কেটস আউটলুকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্য বাণিজ্য, উৎপাদন ও ভোগের ধরনে যে উল্লেখজনক পরিবর্তন এসেছে, তাতে ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত ভোগ্যপণ্যের দাম ঐতিহাসিক রকমের উচ্চ থাকবে। পাশাপাশি, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) দুটি সংস্থাই সতর্ক করেছে, প্রচণ্ড রকমের খাদ্য অনিরাপত্তার কারণে ২০২২ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, খাদ্য অনিরাপত্তার মধ্যে থাকা কয়েকটি আফ্রিকান দেশে মিশ্র প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। গত জুনে এফএও–র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ইরিত্রিয়ার মোট গম আমদানির পুরোটুকুই রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে করেছে। পরপর চারটি বর্ষা মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়াকে কেন্দ্র করে অসহায়ত্বের মধ্যে থাকা সোমালিয়ায় বেড়েছে অপুষ্টির হার। সেখানে গমের দাম দ্বিগুণ হয়েছে।
অবশ্য, চুক্তি স্বাক্ষরের পর তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান জোর দিয়েই বলেছেন, এ চুক্তির কারণে শত কোটি মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে। তিনি বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে আমরা জাহাজ চলাচল শুরু হতে দেখব এবং অনেক দেশের মানুষই স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারবে।
বছরের এ সময়ে রাশিয়া, ইউক্রেনসহ কৃষ্ণসাগর অঞ্চল এবং ভারত, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে নতুন গম ওঠে। বিশ্বের মোট গমের ৪০ শতাংশ ওই অঞ্চলে উৎপাদিত হয়। সেখানকার প্রধান কৃষি রপ্তানি পণ্য হচ্ছে গম। এর বাইরে ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে বাকি গম উৎপাদিত হয়। কিন্তু এ দেশগুলোর গমের মান বেশ ভালো, দামও বেশি। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ উন্নত দেশগুলো এসব দেশ থেকে গম কেনে। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের গুদামগুলোতে আটকে ছিল প্রায় আড়াই কোটি টন গম ও ভুট্টা।
ইউক্রেন এবং রাশিয়া বিশ্বব্যাপী খাদ্যের ১০ ভাগের এক ভাগ সরবরাহ করে। তারা বিশ্বের গম রপ্তানির ৩০ শতাংশের পাশাপাশি সূর্যমুখী তেলের ৬০ শতাংশ উৎপাদন করে। কমপক্ষে ২৬টি দেশ তাদের অর্ধেকেরও বেশি খাদ্যশস্যের জন্য রাশিয়া এবং ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল।
উল্লেখ্য, বিশ্বের মোট খাদ্যশস্যের ৩০ শতাংশ যোগান আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। কিন্তু চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষে দু’টি দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় কৃষ্ণ সাগর তীরের এ দু’টি দেশে থেকে গম ও ভুট্টা জাতীয় শস্যের যোগান আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে হু হু করে বাড়তে থাকে গম ও ভুট্টার দাম। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ থেকে এপ্রিল- এক মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ।
আনন্দবাজার/শহক