আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্যবাহী শিল্পের নাম বায়স্কোপ। চার কোনা একটি টিনের বাক্সে গোলাকৃতি ৪ থেকে ৬ টি জানালা। বাঁশি বাজিয়ে আহবান জানিয়ে দুলদুল ঘোড়া, মক্কা- মদিনা, আজমির শরীফ, ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির ছবি ইত্যাদি দেখানো হতো বায়োস্কোপে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, রাজা- বাদশা, জনপ্রিয় নায়ক- নায়িকা, বিভিন্ন ধর্মীয় পবিত্র স্থপনা, মৃত্যুর পরের নানা কাল্পনীক কাহিনীর ৩৫-৪০ টি ছবি ঘোড়া দিয়ে লাগানো হতো। বাক্সের মধ্যে দুই পাশে দুটি ঘুড়ির লাটাইয়ের মতো জিনিস থাকতো যা পেঁচিয়ে স্থির ছবি চলমান রেখে প্রদর্শন করা হতো। বায়স্কোপওয়ালা হাত দিয়ে হাতল ঘুরাতে থাকে আর সুর করে ছবির বর্ণনা করতে থাকে:
‘কী চমৎকার দেখা গেলো
ঢাকা শহর আইয়া গেলো,
মীরজুমলার কামান দেখো
সদরঘাটের জাহাজ দেখো,
বাহির থেকে স্বচ্ছ কাঁচের ওপর রাখলে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতো হয় দর্শকরা। হাত দিয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে দশর্নীয় স্থান কিংবা বিভিন্ন চিত্র কর্মের ছবি দেখানো হতো এই বায়স্কোপ। গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় সব কাহিনী ও কাল্পনিক চিত্রও দেখানো হতো বায়স্কোপে। এই বায়স্কোপ নিয়ে বর্তমান সময়েও শিল্পীরা একাধিক গান গেয়েছেন। বায়স্কেপের ছবি আর সুরেলা কন্ঠের বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে উঠতো এক অজানা পৃথিবী। বাংলাদেশে ৭০ এর দশকেও শহরে ও গ্রামে নিয়মিত দেখা যেত বায়স্কোপওয়ালারা কাঁধে বায়স্কোপ নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিশু ও কিশোর- কিশোরীরা এটা দেখার জন্য মা- বাবার কাছে আবদার করতো। চিরায়ত আদি বিনোদন মাধ্যম ছিলো এই বায়স্কোপ। আধুনিক প্রযুক্তির আগ্রাসনে এক সময়ের জনপ্রিয় বায়স্কোপ শিল্পটি আজ বিলপ্ত । টিভি, সিনেমা, স্মাটফোন, ডিভিডি, ইউটিউব সহ নানা বিনোদন মাধ্যম মানুষের হাতে আসায় বায়স্কোপ এখন কেবলই ইতিহাস।
ক্যামব্রিজ ইংরেজি অভিধান অনুযায়ী বায়স্কোপ অর্থ একটি যন্ত্র যার দ্বারা কোন পর্দায় চলমান চিত্র প্রদর্শিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে মূভি ক্যামারার প্রাচীন নাম হলো বায়স্কোপ। বাংলা চলচিত্র বা বাংলা সিনেমা ১৮৯০ সালে ভারতের কলকাতায় বায়স্কোপ নামে শুরুর হয়েছিল। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দের কলকাতায় বাঙালিদের মধ্যে প্রথম বায়স্কোপ কোম্পানী গঠন করেন মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরী গ্রামের হীরালাল সেন। তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির নাম দ্যা রয়েল বায়স্কোপ কোম্পানী।
ইউরোপে ১৫ তেকে ১৭ শতাব্দীতে বায়স্কোপ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮৯৪ সালের পর এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় বিশ্বব্যাপী এর প্রদর্শনী শুরু হয়। অনেকে ধারণা করেন বায়স্কোপ হলো চলচিত্রের পূর্ণ রুপ।