- নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস অপর্যাপ্ত
- বিকল্প সন্ধানে বাড়াতে হবে গবেষণা
নবায়নযোগ্য জ্বালানি এমন এক শক্তির উৎস যা কম সময়ের ব্যবধানে একাধিকবার ব্যবহার করা যায়। এতে ওই শক্তির উৎস শেষ হয় না। এটি পরিবেশবান্ধব এবং কার্বন নিঃসরণমুক্ত। সেজন্যই বিশ্বের অনেক দেশ এখন বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ঝুঁকছে। বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি উৎসের মধ্যে সৌর শক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময়; পাশাপাশি রয়েছে বায়োগ্যাস ও বায়োমাস। মৌসুমী বায়ুর দেশ বাংলাদেশে বায়ুবিদ্যুতের সম্ভাবনা অপার। তবে তা এখনও গবেষণাধীন। দেশের ১৩টি স্থান থেকে বাতাসের উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। পানি থেকে বিদ্যুৎ, সোলার পিভি ব্যবহার করে সৌর বিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ, পৌর বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ, গোবর ও পোল্ট্রি বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস। আরও সম্ভাবনা দেখাচ্ছে বাতাসের গতি, ধানের তুষ, আখের ছোবরা, বর্জ্য, শিল্ট প্রক্রিয়ার অব্যবহৃত তাপ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদন। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির এ উৎস পর্যাপ্ত নয়।
বর্তমান অবস্থা
বিদ্যুৎ খাতের জন্য তৈরি করা মহাপরিকল্পনা পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যানে (পিএসএমপি) ২০২১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ যোগ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ছিল। ২০১৬ সালের সংশোধিত পিএসএমপি অনুযায়ী পাঁচ বছর শেষ হতে চলেছে। পরিকল্পনার দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও বাস্তবায়নে এখনও বেশ পিছিয়ে। এই পাঁচ বছরে এ পর্যন্ত ৭৭৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে, যা মোট বিদ্যুতের ৩ শতাংশ। এর মধ্যে ৪২৫ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। আর নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পাওয়া মোট বিদ্যুতের সৌর উৎস থেকে ৫৪২ মেগাওয়াট, বায়ু থেকে ২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট, হাইড্রো থেকে ২৩০ মেগাওয়াট, বায়োগ্যাস থেকে শূন্য দশমিক ৬৯ মেগাওয়াট এবং বায়োমাস থেকে শূন্য দশমিক ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ পেতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো জমি সংকট।
চলমান উদ্যোগ
নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ২ হাজার ৫৩১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেতে চায় সরকার। সেজন্য অনেকটা জোরেশোরেই মাঠে নেমেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪ দশমিক ৫ কিলোওয়াট আওয়ার/বর্গমিটার সৌর বিকিরণ হয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা পুরনো হলেও গত পাঁচ বছরে পরিকল্পনা মাফিক এগোতে পারেনি সরকার। ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামের কাপ্তাই হৃদে দেশের প্রথম পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ১৯৮৮ সালে এসে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫০ মেগাওয়াট কাপলান টাইপের টার্বাইন সম্বলিত চতুর্থ এবং পঞ্চম ইউনিট স্থাপন করা হয়। যাতে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ২৩০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সিলেটে প্রথম সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয় বেসরকারি উদ্যোগে। পরবর্তী সময়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) কর্মসূচি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করে। ১৯৯৬ সালে এসএইচএস চালু হওয়ার পর থেকে এটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচি। এ পর্যন্ত প্রায় ৬ মিলিয়ন সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইডকল’র মাধ্যমে সরকার কর্তৃক গৃহীত সমন্বিত কর্মসূচির কারণে এর সংখ্যা বাড়ছে। সোলার হোম সিস্টেম একটি বিশাল এবং বিশ্বস্ত সিস্টেম। এর সফলতার জন্য অনন্য গ্রামীণ ক্রেডিট এবং ‘কস্ট বাই ডাউন’ সিস্টেমের মাধ্যমে গ্রামের বাড়িগুলো কর্মসূচির আওতায় এসেছে।
এছাড়াও নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এবং বিনিয়োগকারীদের সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছে। সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন- বাংলাদেশ ব্যাংক, ইডকল এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
সোলার হোম সিস্টেমের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সরকারি কয়েকটি কর্মসূচি যেমন- সৌর সেচ, সৌর মিনি/মাইক্রো গ্রিড, সোলার পার্ক, সোলার রুফটপ, সোলার বোটিং ইত্যাদি শুরু করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম লক্ষ্য হল গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এবং ডিজেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো। যার ফলে কমবে কার্বন নিঃসরণ এবং সরকারি ভর্তুকি। ইউএনডিপি’র অর্থায়নে স্রেপজেন প্রকল্প থেকে বায়োমাস রিসোর্স ম্যাপিং সমীক্ষা নেওয়া হয়েছে। এই সমীক্ষার পর দেশে বায়োমাসের সম্ভাবনার ওপর একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
আগামীর পরিকল্পনা
কার্বন নিঃসরণ কমাতে এরই মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে সরে এসে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাদ দিয়ে নবায়নযোগ্য উৎসে জোর দিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে বিষয়গুলো যুক্ত করে হালনাগাদ করা হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান (পিএসএমপি)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বর্তমান বিদ্যুতের চাহিদা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশ বিপর্যয় ও তেলের বাজার পরিস্থিতিও মাস্টারপ্ল্যানের বিবেচনায় থাকবে। পাশাপাশি নবায়যোগ্য জ্বালানি নীতিমালা-২০০৮ হালনাগাদের উদ্যোগ নেওয়া, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সোলার রুফটপ সিস্টেম স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করা, সোলার রেডিয়েশন রিসোর্স অ্যাসেসমেন্ট ডাটা সংগ্রহ, নেট মিটারিং গ্রাহকদের জন্য পাওয়ার ফ্যাক্টর স্টাডি, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অফসোর এবং অনসোর ভিত্তিক বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) উদ্যোগে আরও বেশ কিছু স্থানে তথ্য আহরণে প্রয়োজনীয় টাওয়ার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বায়োগ্যাস এবং বায়োমাস জ্বালানির ওপর সমীক্ষা এবং জিআইএস ম্যাপিং, পৌরবর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, ভাসমান সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে উদ্যোগ, বাসাবাড়িতে সোলার হিটিংয়ের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে।
আনন্দবাজার/শহক