ঢাকা | বৃহস্পতিবার
৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

থমকে আছে বায়ুবিদ্যুৎ

থমকে আছে বায়ুবিদ্যুৎ
“জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে কার্বন নিঃসরণমুক্ত বাসযোগ্য বিশ্ব গড়তে উন্নত দেশগুলো এখন সরব হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক শক্তি সংকট দিন দিন ভয়াবহ হয়ে ওঠায় দ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে বিশ্ব। ইতোমধ্যে বহু দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে সময় বেঁধে দিয়েছে। সেই প্রতিশ্রুতিতে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। তবে শক্তি সংকটের ভয়াবহতার মধ্যেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমানে অপার সম্ভাবনা। শুধু সঠিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ আর সময় উপযোগী উদ্যোগ নিলেই সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে জ্বালানি সংকট থেকে আমরা বেরুতে পারবো। বিকল্প জ্বালানির সন্ধান নিয়েই দৈনিক আনন্দবাজারের ধারাবাহিক বিশেষ প্রতিবেদনের আজ প্রথম পর্ব-থমকে আছে বায়ুবিদ্যুৎ।”

সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বিদ্যুতের ৪০ ভাগ চাহিদা মেটানো হবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। যদিও এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে এখনও হাঁটতে শুরু করেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি পেতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো উৎসের ঘাটতি ও জমি সংকট। তাই উৎস হিসেবে এখন বাসা বাড়ির ছাদ এবং নদী তীরের পরিত্যাক্ত জায়গা বেছে নেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। জলবিদ্যুৎ আর সৌরশক্তির পাশাপাশি বিদ্যুৎখাতের সম্ভাবনাময় নতুন খাত হতে পারে বায়ুশক্তি। বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে টেকসই ও নবায়ণযোগ্য জ্বালানির চাহিদা পূরণ সহজ হবে— মত বিশেষজ্ঞদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বাংলাদেশ বায়ু বিদ্যুতের জন্য উপযোগী হলেও কাজে লাগানো হচ্ছে না। পর্যাপ্ত প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের কারণে বায়ু বিদ্যুৎ আশানুরূপভাবে এগোচ্ছে না। জলবিদ্যুৎ, সৌরশক্তির পাশাপাশি নবায়নযোগ্য উৎসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বায়ু বিদ্যুৎ। বাংলাদেশে ৭৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলসহ মোট এক হাজার ২০০ কিলোমিটার এলাকা বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে লাগানো যেতে পারে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে ফেনী নদীর মিরসরাইয়ের উপকূল পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সারা বছর যে প্রাকৃতিক বায়ু প্রবাহ রয়েছে, যা দিয়েই কয়েকটি বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করে পুরো চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলা করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু কার্যকর উদ্যোগ ও বিনিয়োগ।

বায়ুশক্তির সম্ভাবনা
২০১৮ সালের শেষে ইউএসএইড বাংলাদেশের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিনিউবেল এনার্জি ল্যাবরেটরি (এনআরইএল) বাংলাদেশ সরকারের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশের বায়ুশক্তি ব্যবহারের উপযুক্ততা নির্ধারণে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রণয়ন করে। এরপর আশাবাদ তৈরি হয়েছে যে বায়ুশক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইতিবাচক নানা তৎপরতা শুরু হবে। উল্লিখিত সমীক্ষায় দেশের বিভিন্ন এলাকার ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন উচ্চতায় বায়ুপ্রবাহের প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করে একটি উইন্ড ম্যাপ বা বায়ুপ্রবাহের শক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনাপূর্ণ ৯টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদন বোর্ড ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কাঠামোর অধীনে তিনটি পৃথক স্থানের জন্য (প্রতিটি ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বায়ুশক্তিচালিত) বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করতে বলেছে। দরপত্রের শর্তানুযায়ী, আগ্রহী প্রতিষ্ঠান আগামী দুই বছরের মধ্যে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি পৃথক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে চাঁদপুরের কচুয়া, খুলনার মোংলা ও কক্সবাজারের ইনানীতে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চুক্তির অধীন প্রতিষ্ঠানের কাছে নির্ধারিত মূল্যে ২০ বছর ধরে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনে নেবে।

বাংলাদেশে ৬০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন হওয়ার কথা। এর মধ্যে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের। প্রায় ৩৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সামর্থ্য রয়েছে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সোলার প্যানেল বা সোলার হোম সিস্টেমস থেকে। সম্প্রতি নেওয়া উদ্যোগের অধীনে বিদ্যুৎ গ্রিডে সংযুক্ত হয়েছে আরও প্রায় ৩৯ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার সোলার প্যানেলনির্ভর সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সামর্থ্য।

ইতোমধ্যে দেশে স্থাপিত (ফেনী ও কুতুবদিয়ায়) উইন্ড টারবাইন থেকে বায়ুশক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সামর্থ্য ১ মেগাওয়াটের কাছাকাছি মাত্র। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সম্প্রতি নেওয়া উদ্যোগ সফল হলে বায়ুশক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে। সরকার আশাবাদী যে ২০২১ সালের মধ্যে বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হওয়ার কথা ১ হাজার ১৫৬ মেগাওয়াট।

যেভাবে উৎপন্ন বায়ুবিদ্যুৎ
বায়ুশক্তি কাজে লাগাতে সুউচ্চ টারবাইন তৈরি করা হয়। প্রতিটি টারবাইনে তিনটি করে পাখা থাকে। এগুলোর উচ্চতা ১০০ থেকে ৪১০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং পাখার আয়তন ৫০ থেকে ১১০ ফুট হয়ে থাকে। বায়ুর গতিকে কাজে লাগিয়ে টারবাইনের জেনারেটর ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এ ক্ষেত্রে বায়ু যখন টারবাইনের ব্লেডের মধ্যে দিয়ে যায় তখন বায়ুর গতিশক্তি ওই ব্লেডগুলোকে ঘুরায়। আর ওই ব্লেডগুলোর সঙ্গে রোটর সংযুক্ত থাকে যা ব্লেডগুলোর ঘূর্ণনের ফলে সক্রিয় হয়।

এই রোটর জেনারেটরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে যার ঘূর্ণনের ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। সাধারণত যেসব জায়গায় বাতাসের গতিবেগ ২.৩ থেকে ২. ৫ মিটার/ সেকেন্ড হলেই বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম বেশি পড়ে। কিন্তু পাঁচ থেকে ছয় মিটার/ সেকেন্ড বাতাসের গতিবেগ হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করা সম্ভব। উপকূলীয় অঞ্চল বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট উপযোগী বলে মনে করা হয়।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন