ঢাকা | সোমবার
২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমদানি সঙ্কটে জ্বালানি

আমদানি সঙ্কটে জ্বালানি

জ্বালানির বাজার ঘিরে বিশ্বব্যাপী চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। চাহিদা ও জোগানের তারতম্যে এমনিতেই গত আড়াই বছর ধরে তেল-গ্যাসের দাম বেড়ে চলেছে; এর মধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ জ্বালানির সেই সংকটকে নিয়ে যাচ্ছে একেবারে বিপর্যয়ের দিকে। ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চরম পরিস্থিতির মুখোমুখি। সেই ধাক্কা এসে লেগেছে দেশের জ্বালানিখাতেও।

দেশে পরিবহনখাতের ৯০ শতাংশের বেশি গাড়ি নির্ভরশীল আমদানি করা জ্বালানি তেলের ওপর। তাছাড়া ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ বা ৭৮২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। আর দেশের ৮৬ দশমিক ৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনই গ্যাস ও জ্বালানি তেলনির্ভর। যে কারণে গ্যাস সরবরাহ সংকটে চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন।

ঈদের আগে আগে বিদ্যুৎ–বিভ্রাট জনজীবনে নতুন ভোগান্তির সৃষ্টি করেছে। অথচ দীর্ঘ সময় দেশে বিদ্যুৎ–বিভ্রাট ছিল না। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।

এদিকে বৈশ্বিক এমন পরস্থিতিতে মধ্যে জ্বালানি আমদানি ব্যাহত হচ্ছে ডলার সংকটে। ফলে সংকট আরো ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। জ্বালানি তেল আমদানি করতে ব্যাংকে ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। তেল সরবরাহকারী বিদেশি সংস্থার পাওনা পরিশোধ হচ্ছে না নিয়মিত। তারা পাওনা পরিশোধে চাপ প্রয়োগ করছে। ব্যাংক বলছে, ডলার নেই তাদের কাছে। এতে জ্বালানি তেল আমদানি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। দফায় দফায় চিঠি দিয়েও সমাধান আসছে না।

পরিস্থিতি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থবিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) গত ৫ জুলাই একটি চিঠি দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এতে বলা হয়, ‘প্রয়োজনীয় পরিমাণ ডলারের সংস্থানসহ চাহিদা অনুযায়ী এলসি (ঋণপত্র) খোলা সম্ভব না হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে বলে আশঙ্কা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি)।

‘বিষয়টি অতীব জরুরি’ উল্লেখ করে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলায় সৃষ্ট জটিলতা ও প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রাসংকটের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয় চিঠিতে। ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশের চাহিদার প্রায় শতভাগ জ্বালানি তেল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ ডলারের সংস্থান ও ঋণপত্র খোলার বিষয়ে সহযোগিতা চেয়ে ইতোমধ্যে একাধিকবার বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

জ্বালানি বিভাগের চিঠিতে বলা হয়, জ্বালানি তেল আমদানিতে প্রতি মাসে ১৬ থেকে ১৭টি আমদানি ঋণপত্র খুলতে হয়। ঋণপত্রগুলো সাধারণত সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও ইস্টার্ণ ব্যাংকে খোলা হয়ে থাকে। অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের ঘাটতি রয়েছে জানিয়ে ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খুলতে প্রায়ই অপারগতা প্রকাশ করছে। এ ছাড়া ঋণপত্র খুললেও তেল সরবরাহকারীর মূল্য পরিশোধে দেরি হচ্ছে। একাধিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে করে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও ক্রমে বাড়ছে।

বিপিসি সূত্রমতে, গত এপ্রিলের শুরু থেকেই ঋণপত্র খোলা ও তেলের দাম পরিশোধ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়। মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হলে কিছু ডলার ছাড় করা হয়। এরপর আবার ব্যাংকগুলো অস্বীকৃতি জানাতে থাকলে গত ১৭ মে ও ২৩ জুন দুই দফায় জ্বালানি বিভাগে চিঠি পাঠায় বিপিসি। দেশে ৩৫ থেকে ৪০ দিনের জ্বালানি তেল মজুত করতে পারে দেশে জ্বালানি সরবরাহের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিপিসি। ঋণপত্র খোলা না গেলে নতুন করে জ্বালানি তেলের ক্রয়াদেশ দেওয়া যাবে না। এতে করে তেল আমদানি কমে যাবে। আর তাহলে সামনে সরবরাহ–সংকট তৈরি হতে পারে।

আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১১১ শতাংশ
ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। অন্যদিকে রপ্তানি আয় বাড়লেও কমেছে প্রবাসী আয়। এতেই দেখা দিয়েছে মার্কিন ডলারের সংকট। ফলে ডলারের দাম বেড়ে হয়েছে ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা। ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। ব্যাংকগুলোও ঋণপত্র খোলার বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এতেই জ্বালানিসহ বিভিন্ন অতি গুরুত্বপূর্ণ আমদানি নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

রিজার্ভে চাপ
বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের ওপরও চাপ তৈরি হয়েছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ইতোমধ্যে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (এসিইউ) আমদানির অর্থ পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে গেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।

প্রায় প্রতিদিনই জ্বালানি, খাদ্য, কীটনাশকসহ সরকারি বিভিন্ন আমদানির জন্য ডলার বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলছেন, তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক পুরো ডলার না দিয়ে আংশিক দিচ্ছে। আমদানি দায় শোধ করতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ব্যাংকগুলোর নজর দেওয়া প্রয়োজন। তাদের সহায়তা করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করা হচ্ছে।

ব্যাংকে ডলার–সংকট
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালানি পণ্য, কীটনাশক ও খাদ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে থাকে। তবে ১০ কোটি ডলারের চাহিদা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিক্রি করে ৫ কোটি ডলার। বাকি ডলার অন্য ব্যাংক থেকে কিনতে হয়, যাতে দামও বেশি পড়ে। বেশি দামে ডলার কিনে কম দামে বিপিসিকে সরবরাহ করতে হবে ব্যাংকের। এ কারণে অনেক ব্যাংক এখন ঋণপত্র খুলতে চাইছে না।

তেল সরবরাহকারীদের সতর্কবাণী
বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। সৌদি আরবের সৌদি অ্যারাবিয়ান অয়েল কোম্পানি (সৌদি আরামকো) ও আরব আমিরাতের আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (অ্যাডনক) থেকে এ তেল কেনা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় পরিশোধিত জ্বালানি তেল। বছরে ৪০ লাখ টন শুধু ডিজেল আমদানি করে বিপিসি। এ ছাড়া ফার্নেস অয়েল, পেট্রলসহ আরও কিছু তেল আমদানি করতে হয়।

তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্তত দুটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সতর্ক করে বিপিসিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিপিসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় কিস্তিতে টাকা পরিশোধের বিষয়টিও মেনে নিয়েছে সরবরাহকারীরা। এটিও করা যাচ্ছে না বলে তারা সতর্ক করে বলেছে, এমন হলে আর তেল সরবরাহ করা যাবে না।

তিন বিকল্প
জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় তিন বিকল্পের কথা ভাবছে বিপিসি। ডলার সরবরাহ বাড়িয়ে নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলা অব্যাহত রাখা, রেশনিং করে পরিবহনের পেছনে খরচ হওয়া জ্বালানি দ্রুত ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনা এবং করোনাকালের মতো অফিস-আদালতের কর্মসময়ে পরিবর্তন এনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিষয়ে জোর দিতে বলছে সংস্থাটি। তাদের এই ভাবনা প্রস্তাবনা আকারে শিগগির বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে জানাবে বিপিসি। তবে এই সংকটের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা আগে থেকেই রয়েছে সরকারের।

এদিকে, সম্প্রতি তেল–গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির এক সভায় সারাদেশে লোডশেডিংসহ বর্তমান বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সংগঠনটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদ এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ না থাকলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের এই সংকট সামনে আসতোই। তার মতে, যুদ্ধ শুধু সংকটটাকে ত্বরান্বিত করেছে। সামনে জ্বালানি সংকট আরও ভয়াবহ হবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

ডলার সংকটে ব্যাংকগুলো এলসি না খোলায় দেশে জ্বালানি তেল আমদানি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে বলে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একাধিকবার চিঠি দিয়ে জানিয়েছে বিপিসি। তবে এই সংকটের বৃত্ত থেকে বের হওয়ার সমাধান এখনও পায়নি তারা। অথচ ঋণপত্র খোলা না গেলে নতুন করে জ্বালানি তেলের ক্রয়াদেশ দেওয়া যাবে না। এতে ব্যাহত হবে তেল আমদানি। আর আমদানি কমে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘটবে ব্যাঘাত। সংকটে পড়বে পরিবহন খাত। জটিলতা তৈরি হবে কৃষকের সেচকাজেও। আর মূল্যস্ফীতির মধ্যে নতুন করে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি জনদুর্ভোগের সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা।

সংবাদটি শেয়ার করুন