পাবনার কবি বন্দে আলী মিয়ার লেখার সঙ্গে পরিচয় ছোটোবেলা থেকেই হলেও আগ্রহটা আরও বাড়ে যখন আমি কবির বাড়ি পাবনার রাধানগর এলাকায় যাতায়াত করতাম। পড়ালেখার সুবাদেই আমার এই সুযোগ ঘটেছিল। আমার কাছে মনে হয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা সত্ত্বেও কবি বন্দে আলী মিয়া যেন একটু অবহেলিত হয়েছেন।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যাদের সৃষ্টিকর্ম নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে, বন্দে আলী মিয়া তাদের একজন। কিশোর বয়সে তার সঙ্গে পরিচয় ‘আমাদের গ্রাম’ দিয়ে। কবিতাটি পাঠ্য ছিল। ছোটবেলায় আমরা যখন এই কবিতা পড়তাম, তখন মনের ভেতরেই গ্রামের ছবি আঁকতাম। গ্রামের ছবিটা তাই মনে বেশ স্পষ্ট। তবে কবির কবিতায় আঁকা গ্রাম যেন অন্যরকম। আরো বেশি গ্রামময়। একেবারে নিঁখুত গ্রামীণ বর্ণনা।
এ দেশের গ্রামের বর্ণনা বহু কবির বহু কবিতায় চিত্রায়িত হয়েছে। তবে বন্দে আলী মিয়ার মতো চমৎকার গ্রামের বর্ণনা কম পাওয়া যায়। কবিতার প্রথম চার লাইন ছিল-
‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই
এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।’
গ্রামীণ জীবনের পটভূমি রচনায় কবি যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি নেই। অনেক লেখক-কবির ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিবার থেকে সাহিত্যচর্চার একটি ধারা প্রবাহিত হয়। যা পরবর্তী প্রজন্মকেও প্রেরণা যোগায়। বন্দে আলী মিয়া উত্তরাধিকার সূত্রে তেমন সাহিত্যানূকুল্য না পেলেও, প্রতিভা ছিল স্ববৈশিষ্ট্য এবং নিজের ধারাতেই বিকশিত হয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই তার সাহিত্য প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে থাকে। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত ‘ময়নামতির চর’ কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর সব মহলে ব্যাপক প্রশংসা পায় এবং ময়নামতির চরের কবি হিসেবেই পরিচিত হতে থাকেন।
১৯০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর কবি জন্মগ্রহণ করেন পাবনার রাধানগর গ্রামে। তার পিতা মুনশি উমেদ আলী মিয়া এবং মাতা নেকজান নেসা। জীবনের শুরুতে কবি ভর্তি হন পাবনার মজুমদার একাডেমিতে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শেষে কবি ১৯২৩ সালে কলকাতার ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমিতে চিত্রবিদ্যায় ভর্তি হন। কবিতা দিয়েই তার সাহিত্য সাধনার শুরু সেই স্কুল জীবনেই। তার প্রথম গ্রন্থ চোর জামাই প্রকাশিত হয় ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে।
কবিতার মাধ্যমে তিনি কবিতার জগতে আপন ভুবন তৈরি করে নেন। বলা যায়, তিনি ‘ময়নামতির চর’ এর কবি হিসেবে ব্যপক পরিচিত হন। তার এই কবিতা যে কতখানি স্বার্থকতার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিল তা বোঝা যায় সেই কবিতা নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখার প্রশংসা করেছেন। তিনি কাব্যটির চমৎকার মূল্যায়ন করেন এভাবে-
’তোমার ময়নামতির চর কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেলো। তোমার রচনা সহজ স্পষ্ট, কোথাও ফাঁকি নেই। সমস্ত মনের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছ এবং কলমের অনায়াস ভঙ্গিতে লিখেছ। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক শব্দগুলো যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুণ্ঠিত হওনি, তাতে করে কবিতাগুলো আরো সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকটস্পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোনো কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পরছে না। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি।’ (২৬ জুলাই, ১৯৩২)
কবিগুরু যখন কবিতা নিয়ে এমন উচ্ছসিত অভিমত ব্যক্ত করেন তখন এর থেকে বড় পাওয়া আর কবির কাছে কী হতে পারে। যে কবিতার জন্য এত হৈ-চৈ সেই কবিতার প্রথম চারটি লাইন ছিল-
’এ-পারের এই বুনো ঝাউ আর ও পারের বুড়ো বট
মাঝখানে তার আগাছায় ভরা শুকনো গাঙের তট;
এরি উঁচু পারে নিত্য বিহানে লাঙল দিয়েছে চাষী
কুমীরেরা সেথা পোহাইছে রোদ শুয়ে শুয়ে পাশাপাশি।’
এর থেকে সহজ সুপাঠ্য বর্ণনায় বাংলাদেশের চরের এমন বর্ণনা আর কোথায় পেয়েছি। এমন চমৎকার যে মাটি ও মানুষের বর্ণনা তার প্রশংসা তো তার প্রাপ্যই থাকে। সম্পূর্ণ কবিতায় রয়েছে চরে বসবাস করা মানুষ, তাদের জীবন জীবিকার সন্ধান, চরের মাঠ-ঘাট, নদী, প্রাচীন উৎসব, চরের দিন-রাত- এককথায় এ যেন আবহমান বাংলার প্রতিচ্ছবি। মানুষের গ্রামীণ জীবনের কারুকার্যময় বর্ণনা তার কবিতায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কবিকে কেবল এই লেখনীর মধ্যেই সিমাবদ্ধ রাখার সুযোগ নেই। কবির বিচরণ ছিল সহিত্যের সব শাখায়। কবি হিসেবে সমধিক পরিচিতি পেলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, শিশু সাংবাদিক ও চিত্রকর। সাহিত্যের সব শাখাতেই তার বিচরণ ছিল এবং সাফল্য লাভ করেছিলেন। পাঠক অনুরাগ তৈরিতেও তিনি ছিলেন সফল। তিনি যেমন বড়দের জন্য লিখেছেন তেমনি লিখেছেন শিশুদের জন্যও। তার সৃষ্টি জুড়ে রয়েছে পল্লীর মানুষের কথা, তাদের সুখ দুঃখের কথা।
পাবনার গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের সুখ-দুঃখের মাঝে কবির বড় হয়ে ওঠার যে স্মৃতি সেগুলোও তিনি তার কবিতায় তুলে এনেছেন। পল্লী গ্রামের মানুষের যে নিত্য জীবন ধারণের ধারাবাহিকতা, গ্রামীণ ঐতিহ্য, প্রকৃতি এবং প্রকৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন- এসব বারবার কবির লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে।
প্রকৃতির রূপ বর্ণনায় তার হাত ছিল যেন অদ্বিতীয়। নিখুঁতভাবে গ্রামের রূপ তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তার কবিতায়, উপন্যাসে। ফলস্বরূপ তিনি স্থান পেয়েছিলেন মানুষের মনে। তিনি সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় বিচরণ করেছেন। গান, গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রূপকথা, ছোটদের রচনা, স্মৃতিকথাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কলম ধরেছেন। সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকা সত্ত্বেও কবি সাহিত্যের আড়ালে থাকেন। তার উত্তর অজানা।
কবি বন্দে আলী মিয়ার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে কাব্যগন্থ ময়নামতির চর (১৯৩২), অনুরাগ (১৯৩২), পদ্মানদীর চর (১৯৩৩), মধুমতীর চর (১৯৫৩), দক্ষিণ দিগন্ত, কলমিলতা ধরিত্রী (১৯৭৫)। উপন্যাসের ভেতরে রয়েছে অরণ্য গোধূলী, ঝড়ের সংকেত, নীড়ভ্রষ্ট, জীবনের দিনগুলো, বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, শেষ লগ্ন, অস্তাচল, পরিহাস। তার শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে চোর জামাই(১৯২৭), মেঘকুমারী (১৯৩২), বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা (১৯৩২), সোনার হরিণ (১৯৩৯), মৃগপরী, বোকা জামাই, কামাল আতাতুর্ক, ডাইনী বউ, রূপকথা, কুঁচবরণ কন্যা (১৯৬১), ছোটদের নজরুল, শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা (১৯৫৬)।
তিনি ধারাবাহিকভাবেই সাহিত্য সাধনা করে গেছেন। তার সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। একই বছর তার সাহিত্য প্রতিভার জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৭৮ সালে তিনি রাজশাহীর উত্তরা সাহিত্য মজলিস কর্তৃক সংবর্ধিত হন এবং পদক পুরস্কার পান। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে সম্মানিত করেন।
লেখক: শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক