ঢাকা | রবিবার
২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পণ্য পারাপারে গতি

পণ্য পারাপারে গতি

পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার পর দিনের শুরু সকাল ছয়টা থেকে মাওয়া টোল প্লাজা এলাকায় দীর্ঘ সারি ছিল ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারের। যারা টোল দিয়ে সেতুতে ওঠেন, তাদের মধ্যে ছিল বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। সকালে মাওয়া টোল প্লাজা এলাকায় দেখা যায়, পণ্যবাহী ট্রাকের পাশাপাশি বাস, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারে দীর্ঘ সারি। বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকে দলবেঁধে বাস, প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলে করে ঘুরতে এসেছেন পদ্মা সেতুতে। দলগতভাবে ছবি তুলেছেন টোল প্লাজা এলাকায়।

বলা হচ্ছিল পদ্মা সেতুতে দিনে গড়ে প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। প্রথম দিনই এই সম্ভাব্য সংখ্যার চেয়ে বেশি যানবাহন চলাচল করেছে। প্রথম দিন সকাল ছয়টা থেকে বেলা দুটা পর্যন্ত সেতু দিয়ে ১৫ হাজার ২০০ যানবাহন চলাচল করেছে। আজ সোমবার সকাল ছয়টায় পুরো একদিনের হিসাব পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বাসেক) সূত্র জানায়, টোল আদায় কার্যক্রম তিন শিফটে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম শিফট বেলা ২টা, দ্বিতীয় শিফট রাত ১০টায় এবং সর্বশেষ শিফট সকাল ৬টায় শেষ হবে। আজ প্রথম আট ঘণ্টায় মাওয়া প্রান্ত দিয়ে যানবাহন পার হয়েছে ৮ হাজার ৪৩৮টি।

অন্যদিকে, জাজিরা হয়ে ঢাকার পথে যানবাহন এসেছে ৬ হাজার ৭৬২টি। সব মিলিয়ে দুই প্রান্ত দিয়ে যানবাহন আসা-যাওয়া করেছে ১৫ হাজার ২০০টি। এই যানবাহন থেকে টোল আদায় হয়েছে ৮২ লাখ ১৯ হাজার ৫০ টাকা। এর মধ্যে মাওয়া প্রান্তে টোল উঠেছে ৪৬ লাখ ৮৯ হাজার ৫৫০ টাকা। আর জাজিরা প্রান্তে টোল আদায় হয়েছে ৩৫ লাখ ২৯ হাজার ৫০০ টাকা।

বরিশাল শহর থেকে বাসে করে রওনা দিয়ে পদ্মা সেতু হয়ে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় ঢাকায় আসছেন মানুষ। সকাল ৬টা ৫ মিনিটে বরিশাল শহর থেকে যে বিআরটিসি বাস ছেড়ে আসে তা সকাল পৌনে নয়টার একটু আগে জাজিরা প্রান্তে পৌঁছায়। তারপর পদ্মা সেতু পার হয়। সেতু পার হতে সাড়ে ৫ থেকে ৬ মিনিট লাগে। পদ্মা সেতু পার হওয়ার পর ঢাকার কাপ্তান বাজারে পৌঁছেছে সকাল সাড়ে নয়টায়। এভাবে বরিশাল থেকে যেসব গাড়ি ঘাট পার হয়ে ঢাকায় আসতে আগে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা সময় নিতো এখন তা সাড়ে তিন ঘণ্টাতেই পৌঁছে যাচ্ছে রাজধানীতে।

এদিকে, খুলনা থেকে সকাল সাতটায় রওনা হওয়া এক যাত্রী মাত্র দুই ঘণ্টায় মাওয়া এসে পৌঁছান। এখানে এসে নাশতা করেন এবং গ্রুপ ছবি তুলে আবার খুলনায় গিয়ে দুপুরের খাবার খাবেন। দুপুর ১২টার দিকেও পদ্মা সেতুর ওপরে দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা যায়। কেউ কেউ সেলফি তুলছিলেন।

রাজধানী থেকে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে (জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক) হয়ে পদ্মা সেতুর মাওয়া টোল প্লাজা প্রান্তে পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ২৫ মিনিট। প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, জিপ ও মোটরসাইকেলে লাগবে এ সময়। পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ৬-৭ মিনিট। অর্থাৎ ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু পার থেকে মোট সময় লাগবে ৩২ মিনিটের মতো।

বর্তমানে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়নের অবস্থা তেমন উন্নত ও যুগোপযোগী নয়। এই অঞ্চলে কৃষিপণ্য উৎপাদন হয় বটে, কিন্তু যোগাযোগ সমস্যার কারণে দরিদ্র কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতো। পদ্মা সেতু এই পরিস্থিতির অবসান ঘটছে।

পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার পরপরই এ সেতুকে কেন্দ্র করে নতুন শিল্প-কলকারখানার জন্য উদ্যোগী হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন স্থানে জমি বরাদ্দ নিয়েছে। বেড়ে গেছে জমির দামও। সেতুর মাধ্যমে দেশের প্রধান ১০টি মহাসড়কের ৯টিই ফেরি পারাপারের ভোগান্তিমুক্ত হবে (ঢাকা থেকে পাটুরিয়া হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত বাদে)। দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত নিয়ে আসবে পদ্মা সেতু।

এতোদিন সাতক্ষীরা থেকে রাজধানীতে পণ্য আনতে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাট বা মানিকগঞ্জের আরিচা ঘাটে এসে ফেরি পার হতে হয় পণ্যবাহী গাড়িগুলোকে। এতে অন্তত ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। আর যানজটের সৃষ্টি হলে সময় বেড়ে আরও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। শুধু তাই নয়, ঘাটে গিয়েই ফেরিতে ওঠার নিশ্চয়তা নেই। সময় মতো ফেরি না পাওয়ায় এই নদীর পাড়েই কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঝড়, বর্ষা, নদীর প্রবল স্রোত কিংবা ঘন কুয়াশায় পদ্মার পাড়েই কেটে যায় দিন-রাত। এতে পচনশীল দব্য নষ্ট হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসায়ীরা।

তবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ায় চিরকালীন সেই ভোগান্তির অবসান হচ্ছে। সেই সঙ্গে পণ্য পরিবহনে আসছে যুগান্তকারী গতি। মাত্র চার থেকে পাঁচ ঘণ্টাতেই সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় পণ্য আনা যাবে। পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার প্রথম দিন যেপনের হাজারের বেশি যানবাহন পারাপার হয়েছে তার এক ‍তৃতীয়াংশই ছিল পণ্যবাহী গাড়ি।

দক্ষিণ অঞ্চল থেকে যারা পণ্য নিয়ে এসেছে রাজধানীতে তারা হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন। পদে পদে ভোগান্তি আর সময়ক্ষেপণের চিরচেনা সেই চিত্র ছিল না। পদ্মা সেতুর কারণে এক টানে ওপার থেকে এপারে আসতে পেরেছে পণ্যবাহী যান। আগে ঘাট দিয়ে পণ্য পরিবহনের যে চিত্র ছিল তা আর নেই ফেরিঘাটে। মূলত, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে শরীয়তপুরের মাঝিকান্দি ঘাট থেকে ফেরি চলাচল। কর্মব্যস্ত ফেরিঘাটে সুনসান নীরবতা। ঘাটে গাড়ির শব্দ নেই। অনেকে দোকান খোলেনি। কেউ দোকান অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন