শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষায় পদ্মা কখনো নাব্যতা সংকটে ভোগে, কখনও খরস্রোতা, কখনও বা কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে। তাই দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে পদ্মা পাড়ি দিতে ভোগান্তি থাকে সব সময়ই।
গত রোজার ঈদের পর বরিশাল থেকে ঢাকায় ফেরার পথে দুপুর ১২টায় দৌলতদিয়া ঘাটে পৌঁছায় আমাদের বাস। তবে দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঠিক সন্ধ্যা নামার আগ মুহূর্তে ফেরিতে ওঠার সুযোগ হয়। অপেক্ষারত ওই সময়টাতে আমাদের সঙ্গী ছিল বৈশাখের কাঠফাটা রোদ আর ধুলা। একই সঙ্গে বলার প্রয়োজন বোধ করি- ছেলেদের ওয়াশরুম জটিলতা তেমন না থাকলেও মেয়েদের জন্য এই কষ্টটা তীব্রই হয়।
যাই হোক, রাত ৮টায় আমাদের বাস যখন আমিনবাজার ব্রিজের কাছে তখন সুপারভাইজারের হাঁকডাক, বাস গাবতলী টার্মিনালে যাবে না। যুক্তি হিসেবে তিনি দাঁড় করিয়েছিলেন- এই বাস নাইটে বরিশালে ব্যাক করবে। অলরেডি তারা লেট। রায়েরবাজারে যাত্রী অপেক্ষা করছে। তাই সহজ পথ হিসেবে বেড়িবাঁধ দিয়ে রায়েরবাজারে যেতে চেয়েছিলেন তারা। আর যেমন কথা তেমনই কাজ। আমাদের এমন একটা জায়গায় নামতে হয়েছিল যেখানে সিএনজি তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছিল না। যেহেতু আমার সঙ্গে অনেক ভারী কিছু ছিল তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই রিকশা নিয়েছিলাম।
রিকশা গাবতলী টার্মিনালে আসতেই ট্রাফিক পুলিশ থামার জন্য সিগনাল দিল। সঙ্গে সঙ্গে চালক রিকশার সিটের নিচে পলিথিনে মোড়ানো কী একটা রাখলো এবং কাকে যেন মোবাইলে তা জানালো। আমি তাৎক্ষণিক রিকশা থেকে নামতে চাইলে চালক আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ শুরু করলো এবং সঙ্গে সঙ্গে ৮-১০ জন রিকশাচালক চলে আসলো। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে আমাকে ইয়াবা পাচারকারী তকমা দিয়ে ব্যাগ তল্লাশির প্রস্তুতি নিল তারা। যাই হোক সে যাত্রায় নিজের মাথা খাটিয়ে মাত্র ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে সসম্মানে বাসায় ফিরতে পেরেছিলাম আমি।
বছরখানেক আগে লকডাউনের পরে কোরবানির ঈদের ঠিক আগ মুহূর্তে একই পথে বরিশাল থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম। দুপুর একটায় দৌলতদিয়া ঘাটে পৌঁছালেও ফেরিতে উঠতে উঠতে রাত সাড়ে ৮টা বেজেছিল। কারণ ফেরিতে উঠতে মানুষের চেয়ে তখন গরুর গাড়িকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। বাণিজ্য বলে কথা। মানিকগঞ্জ পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার ফোনের চার্জ শেষ। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আমি রাত ১টায় গাবতলীতে পৌঁছালাম। যে সিএনজিই আমি নিতে চাই তারই দেখি আমার প্রতি অনেক আগ্রহ, ভাড়াও কম। অজানা ভয়ের কারণেও আমার এমন মনে হতে পারে, সত্যিটা জানা ছিল না।
এভাবে কয়েকটা সিএনজি দেখার পরে একটাতে উঠলাম। এরপর মোবাইলে কথা বলার মিথ্যা নাটক করে সিএনজির নাম্বারটা একবার চালককে শোনালাম। রাত ২টার দিকে যখন বাসার নিচে নামলাম তখন সিএনজির চালক আমার খুব প্রশংসা করলো এবং রাস্তায় চলার জন্য আমি পারফেক্ট বলে জানালো। আমিও ভাই বলে তাকে বিদায় দিলাম।
মনে পড়ে গত ডিসেম্বরে নাইটে তীব্র শীতের মধ্যে যখন বোন দুলাভাইয়ের সঙ্গে বরিশাল যাচ্ছি, তখনও আমাদের দীর্ঘ যানজটের সারি পেরোতে হয়েছিল। রাত ১২টার পরে যখন ফেরিতে উঠি তখন স্বস্তি পেয়েছিলাম এই বুঝি বাড়িতে চলে গেলাম। কিন্তু বিধি বাম, ফেরি মাঝনদীতে পৌঁছানোর পর আবার পেছনে ব্যাক করতে হয়েছিল। কারণ সামনে তীব্র কুয়াশা। সার্চলাইট সেই কুয়াশা ভেদ করতে পারছে না। সকাল ৭টা পর্যন্ত আমরা ভেসেছিলাম পদ্মায়।
এমনও অনেকবার হয়েছে নাইটে বরিশালের উদ্দেশে রওনা হয়েছি, আর ফেরিতে উঠেছি পরদিন রাত ৮টায়। গত ১২ বছরে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে এমন অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার।
তাই আমার মতো দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে পদ্মা সেতু শুধু প্রয়োজনই না, একটা আবেগের নাম। ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এতোদিনে আমাদের পাশে কেউ দাঁড়িয়েছেন…।
লেখক: সংবাদকর্মী