মসলার উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি কমবে
–শরিফা খান, সচিব, কৃষি, পানি ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন
চলতি অর্থবছরের ১৮তম তথা শেষ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় ৯টি প্রকল্প উত্থাপন করা হবে। প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫টি মন্ত্রণালয়ের এসব প্রকল্প প্রস্তাবনা তুলে ধরা হবে। এরমধ্যে রয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ’ প্রকল্প। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
বর্তমান বিশ্বে ১০৯ ধরনের মসলা চাষ করা হয়। আর দেশে প্রায় ৫০ ধরনের মসলা ব্যবহার করা হলেও মাত্র সাত ধরনের মসলা জাতীয় ফসল উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশে মসলার চহিদা ৩৩ লাখ মেট্রিকটনের মধ্যে ২৭ লাখ মেট্রিকটন উৎপাদন হয়। বাকি ছয় লাখ মেট্রিকটন মশলা বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এজন্য সরকারের প্রতিবছর চার হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হচ্ছে।
দেশে বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকার মসলার বাজার বিদ্যমান। তবে এই মসলার চাহিদার একটা বড় অংশ পূরণ হচ্ছে বিদেশ থেকে আনার মাধ্যমে। অবৈধ পথে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হচ্ছে এসব মসলা। এ ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভরতা কমাতে স্থানীয়ভাবে মসলার উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এবার মসলার এ আমদানি নির্ভরতা নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার। এর মাধ্যমে দেশে মশলার আবাদ ৫ শতাংশ বাড়বে। প্রকল্পের মাধ্যমে ২ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন মশলা উৎপাদন বাড়বে। ফলে আমদানি নির্ভরতা কমবে। উন্নত জাতের মসলা ফসলের বছরব্যাপী উৎপাদন বাড়ানো হবে। আমদানি ব্যয় হ্রাস এবং মসলাজাতীয় ফসল চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গতিশীলতা আনতে মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা হবে।
আগামী মঙ্গলবার একনেক সভায় প্রকল্পটি উপস্থাপন করা হবে বলে জানায় পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পটির মাধ্যমে মসলায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব কিনা এমন প্রশ্ন ছিল পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) শরিফা খানের কাছে। জবাবে এ সচিব বলেন, একটা প্রকল্পের মাধ্যমেই স্বয়ংস্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব না। চাহিদার তো শেষ নেই। তবে দেশে আগে কোনদিন জিরা উৎপাদন করা হতো না। এ প্রকল্পের মাধ্যমে জিরার জাত উদ্ভাবন করা হবে। পিয়াজের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। আমদানি বিকল্প পণ্য হিসেবে কাজে দিবে। উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি কমবে।
আর উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে এ সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ধান,গম বা অন্য শাকসবজির চেয়ে মসলার দাম বেশি। এটা দীর্ঘসময় রেখে দেওয়া যায়। ফলে কৃষকরা যখন দেখবে এটা লাভবান এবং অল্প জায়গায় করতে পারছে তখন অবশ্যই এটার উৎপাদন বাড়বে।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পটি এ বছরের জুলাই হতে ২০২৭ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। দেশের ১১০ টি উপজেলা ও ২৫ টি হর্টিকালচার সেন্টারে এটা বাস্তবায়ন করা হবে। আধুনিক -টেকসই প্রযুক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণের মাধ্যমে মসলা জাতীয় ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণ করা হবে। মসলা ফসল সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে উৎপাদনোত্তর অপচয় হ্রাস এবং শস্য নিবিড়তা ২ থেকে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হবে। মসলা প্রক্রিয়াজাতকরণ ও মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি এবং প্রতিকূল পরিবেশে অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন জাত প্রচলন করা হবে।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- প্রকল্পের মাধ্যমে ২৮ হাজার ৬৫২ টি মসলা প্রদর্শনী এবং চারা-কলম উৎপাদন ও আমদানি। ৩০২ টি বিভিন্ন ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়। ৪ হাজার ২০০ রানিং মিটার সীমানা প্রাচীর ও ১৮৫ টি পলি শেড -গার্ড শেড – লেবার শেড ও নার্সারি শেড নির্মাণ করা হবে। ২ হাজার ৬৫০ ব্যাচ কৃষক প্রশিক্ষণ , ৪৫ ব্যাচ এসএএও – সমমানের কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ, ২৯ ব্যাচ কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ ও ২ ব্যাচ বৈদেশিক প্রশিক্ষণ এবং ১৩৫ ব্যাচ কৃষক উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ এবং ১ হাজার ৬৫০ টি কৃষক মাঠ দিবস আয়োজন করা হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, মসলার অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক চাহিদা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর বাজার মূল্য অন্যান্য ফসলের তুলনায় বেশি। অভ্যন্তরীণ চাহিদার অধিকাংশই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়ে থাকে। আমদানি নির্ভরতা কমাতে স্থানীয়ভাবে মসলার উৎপাদন বাড়ানো প্রয়োজন। বাংলাদেশ মসলা গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত ২২ টি মসলা জাতীয় ফসলের ৪৭ টি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। এছাড়া, মৃত্তিকা ও পানি ব্যবস্থাপনা, পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা, পোস্ট-হারভেন্ট প্রযুক্তিসহ ৬৬ টি উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। এ সকল জাত ও প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশে মসলার উৎপাদন ও কৃষকের আয় বৃদ্ধি এবং আমদানি নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বিশ্ব বাজারে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মসলা উচ্চমূল্য এবং কম আয়তনিক পণ্য জাতীয় পণ্য। উদ্ভিদের কুড়ি, ফল, বীজ, বাকল, রাইজম এবং কন্দ যা খাদ্যের রং, সুগন্ধি, সুম্বাদু এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহৃত উপাদান হলো মশলা। সারাবিশ্বে ১০৯ প্রকার মসলা জন্মে তার মধ্যে এ ৭টি গুরুত্বপূর্ণ প্রধান মসলাই বাংলাদেশে জন্মে। দেশে প্রায় ৫০ ধরনের মসলা ব্যবহার হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন এসব মসলার চাহিদার বেশির ভাগটাই পূরণ করা হতো আমদানির মাধ্যমে। বেশ কিছু জাতের দামি মসলা এখনো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় । আবার অবৈধ পথেও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসছে মসলা। এ ক্ষেত্রে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানোর আরো সুযোগ থাকলেও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
মসলা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত ২২ টি মসলা জাতীয় ফসলের ওপর সর্বমোট ৪৭টি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। তাছাড়া উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উৎপাদন প্রযুক্তি, মৃত্তিকা ও পানি ব্যবস্থাপনা, পোকামাকড় ও রোগ বালাই ব্যবস্থাপনা, পোস্ট – হারভেস্ট প্রযুক্তিসহ আরও ৬৬টি উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। এ সকল জাত ও প্রযুক্তি অভিভূত মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ হলে একদিকে বাড়বে উৎপাদন অন্যদিকে কমবে সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমাণ এবং মসলার আয়ুর্বেদিক, খাদ্য এবং শিল্পে ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে বহুগুণ।
আনন্দবাজার/শহক