ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দক্ষিণে পর্যটনে কচ্ছপগতি

দক্ষিণে-পর্যটনে-কচ্ছপগতি

পদ্মা সেতুর কারণে ঘাড়ে সম্ভাবনার নিঃশ্বাস

  • ঝুলে আছে ফরিদপুর-ভাঙ্গা-কুয়াকাটা মহাসড়ক প্রকল্প
  • বরিশালে আজও নির্মিত হয়নি কোনো পর্যটন মোটেল

স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলে অপার সম্ভাবনা পর্যটন শিল্পে নতুন দ্বার উন্মোচনের সুযোগ সৃষ্টি হলেও তা নিয়ে তেমন কোনো বাস্তব উদ্যোগ লক্ষ্যণীয় নয়। অথচ পদ্মা সেতু হয়ে সাগর সৈকত কুয়াকাটার দূরত্ব মাত্র ২৬৫ কিলোমিটার। যা ঢাকা থেকে কক্সবাজারের চেয়ে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার কম। সম্পূর্ণ ফেরিবিহীন ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটায় সড়ক পথে ৬ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

এছাড়া শের এ বাংলা একে ফজলুল হক, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ও প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাসের স্মৃতি বিজরিত বরিশালেও পৌঁছানো সম্ভব হবে সাড়ে ৪ ঘণ্টায়। তবে এজন্য ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু ও এক্সপ্রেস ওয়েতে ভাঙ্গা পৌঁছানোর পরে একশ কিলোমিটার দক্ষিণে বরিশাল হয়ে ২১০ কিলোমিটার দূরে সাগর সৈকত কুয়াকাটা পর্যন্ত জাতীয় মহাসড়কটি ৬ লেনে উন্নীত করার কোনো বিকল্প নেই।

গত ২০১৫ সালে ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার পরে সে প্রকল্পটিও ঝুলে আছে। এমনকি এ প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণে ২০১৮ সালে এক হাজার ৮শ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থ বরাদ্দের পরেও গত ৪ বছরে ১ শতাংশ জমিও অধিগ্রহণ হয়নি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও নকশা প্রণয়ন করা হলেও ৫ বছরে আগের সে সমীক্ষার আদলে এখন আর অর্থায়নে রাজি নয় দাতা সংস্থাটি। ফলে এ প্রকল্পের ভবিষ্যত এখন দীর্ঘসূত্রিতায় বাধা বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।

এদিকে সাগর সৈকত কুয়াকাটায় রাষ্ট্রীয় পর্যটন করপোরেশন ১৯৯৫ সালে একটি হলিডে হোম এবং ২০১০ সালে একটি মোটেল নির্মাণের পরে সেখানের পর্যটন শিল্পকে আরও গণমুখী ও পর্যটক বান্ধব করার আর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বরিশাল বিভাগীয় সদরে আজ পর্যন্ত কোনো পর্যটন মোটেলও নির্মিত হয়নি। এ লক্ষ্যে ২০১৮ সালে পর্যটন করপোরেশন জমি ইজারা নিয়ে বছর বছর অর্থ পরিশোধ করলেও সে প্রকল্পটিও সম্পূর্ণ অন্ধকারে। অথচ বরিশাল মহানগরী সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের একটি ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত। দেশ-বিদেশের পর্যটকসহ কর্ম উপলক্ষে দক্ষিণাঞ্চলে আগতরা এ মহানগরী ছুঁয়েই সর্বত্র যাতায়াত করেন। কিন্তু বরিশালই একমাত্র বিভাগীয় সদর যেখানে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পর্যটন সংস্থার কোনো স্থাপনা গড়ে ওঠেনি।

অথচ এ মহানগরীতে একটি মোটেল এবং ট্যুরিজম ট্রেনিং সেন্টার করার লক্ষ্যে ২০১৮ সালে কীর্তনখোলা নদীর তীরে বিআইডব্লিউটিএর অধুনালুপ্ত মেরিন ওয়ার্কশপের অভ্যন্তরে ৩০ বছরের জন্য ১ একর জমি লিজ নেয় পর্যটন করপোরেশন। ১৫৩ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ ‘বরিশাল পর্যটন মোটেল ও ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন প্রকল্প’ নামের একটি ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা-ডিপিপি’ বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন শেষে পরিকল্পনা কমিশনে দাখিলের পরে সেখান থেকে তা অনুমোদন না দিয়ে অর্থ মন্ত্রনালয়ের সম্মতি গ্রহণের কথা বলা হয়। যা দেশের সরকারি সংস্থার প্রকল্পের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিরল ঘটনা বলে জানা গেছে।

কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় আশ্চর্যজনকভাবে ওই প্রকল্পটির জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দের পরিবর্তে প্রকল্প ব্যয়ের ৬৬ দশমিক ৬৬ ভাগ অর্থ সরকারি অনুদান এবং অবশিষ্ট ৩৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ পাঁচ ভাগ সুদে ১৫ বছরে পরিশোধ করার শর্তে ঋণ গ্রহণের কথা বলেছে। এরপর থেকেই বিষয়টি অনিশ্চয়তার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। ইতোপূর্বে সংস্থাটির কোনো প্রকল্পে এ ধরনের শর্ত জুড়ে দেয়নি মন্ত্রণালয়। ফলে পুরো প্রকল্পটি এখনো ঝুলে আছে। অথচ পর্যটন করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকে জমির ইজারা বাবদ প্রতিবছর বিআইডব্লিউটিএকে প্রায় আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।

বরিশালে প্রস্তাবিত ৮ তলা মোটেল ভবনটিতে ৮০টি কক্ষ থাকার কথা। একাধিক লিফট সম্বলিত এ ভবনে দুটি এক্সিকিউটিভ স্যুট, ৩৮টি দ্বৈত শয্যার কক্ষ ও ৪০টি তিন শয্যার কক্ষ নির্মাণের প্রস্তাবনা ছিল। এছাড়াও অত্যাধুনিক মানসম্মত রেস্টুরেন্ট, পুল ক্যাফে, সুইমিং পুল, জিম ও স্পা সুবিধারও প্রস্তাব করা হয়েছে। মোটেলটির পাশের কীর্তনখোলা নদীতে ভবিষ্যতে রিভার ক্রুজের ব্যবস্থা সম্বলিত আরও একটি প্রকল্প বাস্তবায়নেরও কথা ছিল। ফলে পর্যটকগণ মোটেলটির পার্শ্ববর্তী কীর্তনখোলা নদীতে নৌবিহারও করতে পারতেন। এছাড়া এ পর্যটন মোটেলে সংযুক্ত ট্রেনিং সেন্টারটিতে প্রতি ব্যাচে ৪০ জন বেকার যুবক ও যুব মহিলাকে হোটেল ম্যানেজমেন্ট ও টুরিজমের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদানের প্রস্তাব ছিল। সাড়ে ৩ মাসের এ প্রশিক্ষণ শেষে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সার্টিফিকেট প্রদানের কথা।

ঢাকার বাইরে বরিশালে একটি ‘হোটেল ম্যানেজমেন্ট ও টুরিজম ট্রেনিং সেন্টার’ স্থাপিত হলে বিদেশে বিপুল চাহিদার এ ধরনের দক্ষ কর্মী গড়ে তোলাও সম্ভব ছিল। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের নানামুখী শর্তে পুরো প্রকল্পটি সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার কবলে। অথচ ৩০ বছরের জন্য জমি ইজারা নিয়ে ইতোমধ্যে ৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, প্রকল্প অনুমোদনেরই কোনো খবর নেই। তবে সরকারি প্রায় ১৬ দশমিক ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরী থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দীঘির পাড়ে পর্যটন করপোরেশন একটি বিশ্রামাগারসহ পিকনিক স্পট গড়ে তুলছে। যা আগামী জুনের মধ্যেই চালু করা সম্ভব হবে বলে জানাচ্ছে পর্যটন করপোরেশন সূত্র।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন