পদ্মা সেতু বাঙালির মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রতীক। অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার পথপ্রদর্শক। দক্ষিণের ২১টি জেলাকে কর্মচঞ্চল করে তোলার যাদুর কাঠি। এটি যুক্ত হবে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ভুটান, নেপাল এমনকি এশিয়ান হাইওয়েতে। পদ্মার স্রোত প্রতিটি ঘরে বয়ে আনবে অর্থনৈতিক জোয়ার। গবেষণামতে, পদ্মা সেতু চালু হবার পর বছরে প্রায় বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ১.০৪ শতাংশের কর্মসংস্থান হবে। আরও সহজ করে বলা যায় আগামি পাঁচ বছরে দশ লাখ অর্থাৎ বছরে দুই লাখ মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে। দশ বছর পর এই সংখ্যা তিনগুণ হয়ে যাবে।
অন্যদিকে, পদ্মা সেতু ঘিরে ইতোমধ্যে বড় বড় অর্থনৈতিক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। যা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে যেমন প্রসারিত করবে, তেমনি ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করবে। ইতোমধ্যে পদ্মার চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, বিমান বন্দরসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা ভাবছে সরকার। এ ছাড়া এপিআই পার্ক (অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট) আগেই গড়ে তোলা হয়েছে। পদ্মা সেতুর কাছেই দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী গড়ে উঠছে। এখানে থাকবে আধুনিক আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব সুযোগ-সুবিধা।
পদ্মা সেতুর আশপাশে গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটবে। খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালীতে শিপ-বিল্ডিং শিল্পের বিকাশ ঘটবে। মোংলা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, মোংলা ইপিজেড, পায়রা বন্দর, রূপপুর প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা গেলে এসব প্রকল্পে বিপুল কর্মসংস্থান ঘটবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু একটি রূপান্তরমুখি প্রকল্প। পদ্মা সেতু শুধু আবেগের জায়গা নয় বরং এটি ভুটান, নেপাল, পশ্চিমবঙ্গ, আসামের সঙ্গে উপ-আঞ্চলিক ব্যবসায়িক জোনে পরিণত হবে। ট্রান্স এশিয়া হাইওয়ের সঙ্গে আমরা যুক্ত হয়ে যাবো। সুতরাং আমাদের ব্যাংক, আইসিটি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন প্রকল্পে স্টার্টআপের জন্য যে বাজেট আছে তার বিশাল একটি অংশ এখানকার মানুষের জন্য বিনিয়োগ করা দরকার। পাকিস্তানের ভারতের সঙ্গে ৭০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা ছিল সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা দূর থেকে পণ্য আনার চেয়ে কাছের দেশগুলো থেকে পণ্য আনতে পারলে খরচ অনেক কমে যাবে।
ড. আতিউর রহমান বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে বছরে ১.২৬ শতাংশ গ্রোস ডমেস্ট্রিক প্রোডাক্ট-জিডিপিতে যুক্ত হবে। রেলে ১ শতাংশ, ২১ জেলায় ৩.৫ শতাংশ জিডিপি বাড়বে। ১.২ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বছরে ২ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এর প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে পড়বে। মূলত পদ্মা রূপান্তরবাদী প্রকল্পে দাঁড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নরের মতে, দক্ষিণ বাংলার প্রতিটি গ্রামেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে। এই অঞ্চলের কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা তার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পারবেন। অন্যদিকে তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারবেন তাদের গ্রামের ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু হবে শুনেই ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হতে শুরু করেছে।
ড. আতিউর রহমান বলেন, বরিশাল শহরের আশে পাশের জমির দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। পদ্মা সেতুর দুই পারেই এক্সপ্রেসওয়ের পাশের জমির দাম তিন-চারগুণ বেড়ে গেছে। নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, আবাসন প্রকল্প, রিসোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেকপার্ক, মানবসম্পদ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট ও নানা ধরনের এসএমই উদ্যোগ স্থাপনের হিড়িক পড়ে গেছে। খুলনা ও বরিশালে জাহাজনির্মাণ শিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। কুয়াকাটায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটছে দ্রুত গতিতে। আগামীতে বিকাশের এই ধারা আরও বেগবান হবে।
শিল্প ও বাণিজ্যিকপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার বিষয়ে ড. আতিউর বলেন, ঢাকার কাছে বলে পদ্মার ওপারে ছোট-বড় নানা শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। দক্ষিণ বাংলা হবে পর্যটনের এক উৎকৃষ্ট হাব। ছুটি পেলেই ঢাকা ও অন্যান্য নগরের বাসিন্দারা ছুটবেন দক্ষিণ বাংলার প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের সন্ধানে। তারা যাবেন কুয়াকাটা, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ এবং টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি পরিদর্শনে, যাবেন পায়রা বন্দরে। পদ্মার চরগুলোতে গড়ে উঠবে নতুন নতুন রিসোর্ট ও পরিকল্পিত ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র। সরকারও এরই মধ্যে নানা পরিকল্পনা নিচ্ছে পদ্মা পারের পুরো এলাকাকে উন্নত করার লক্ষ্যে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের স্বপ্নের প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী এটি উদ্বোধন করবেন। এই প্রকল্পটি সময় মতো হচ্ছে। এতে ব্যয় অন্যান্য প্রকল্পের মতো নয়। এটি অর্থনৈতিক একটি দিক উন্মোচন করবে। শুধু দক্ষিণ নয় দেশের অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব বিস্তার করবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজের ডিন নীলাঞ্জন কুমার সাহা বলেন, সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩.৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে (২০১৮ সালের প্রাক্কলন অনুযায়ী) নির্মিত ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতু। এটি জনসাধারণ ও পণ্য পরিবহন, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে একটি সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুয়ারও উন্মোচন করে দেবে। অর্থাৎ পদ্মায় এবার উন্নয়নের ঢেউ উঠবে।
নীলাঞ্জন কুমার সাহা বলেন, ২০১০ সালের নিউজিল্যান্ডভিত্তিক সেতু নকশা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মৌনসেলের সমীক্ষায় সেতুর সুবিধা-খরচের অনুপাত ১.৭ গুণ এবং অর্থনৈতিক অভ্যন্তরীণ ফেরত হার ১৮ শতাংশ দেখানো হয়েছে, যা সাধারণত কোনো বিনিয়োগের মানসম্মত ফেরত হার (১২ শতাংশের) চেয়েও অনেক বেশি। ফলে গাণিতিক হিসাবেও এই সেতু অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে।
নীলাঞ্জন কুমার সাহা বলেন, সেতু বিভাগ নিযুক্ত যৌথ পরামর্শদাতা সংস্থার (আরপিটি-নেডকো-বিসিএল) সমীক্ষা অনুসারে, পদ্মা সেতু প্রকল্প দেশের জিডিপি ১.২৩ শতাংশ বাড়বে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২.৩ শতাংশ। জাইকার সমীক্ষা মতে, পদ্মা সেতু আঞ্চলিক জিডিপি ৩.৫ শতাংশ এবং দেশজ জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
তিনি জানান, সেতু নির্মাণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ২৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সেতু বিভাগ যা ৩৫ বছরে ১ শতাংশ সুদে (সুদসহ মোট ৩৬ হাজার কোটি টাকা) বছরে ৪ কিস্তিতে মোট ১৪০টি কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে। পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, টোল থেকে প্রাপ্ত অর্থে ২৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে সেতু নির্মাণ ব্যয় উঠে আসার কথা। এডিবির একটি সমীক্ষা মতে, পদ্মা সেতু দিয়ে ২০২৪ সালে প্রতিদিন গড়ে ২৪,০০০ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে গড়ে ৬৭,০০০ যানবাহন চলাচল করবে।
মন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম তার এক লেখায় জানান, ১৯৯৯ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের প্রথম মেয়াদের শেষের দিকে ৪ জুলাই ২০০১ মাওয়া প্রান্তে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অসার ও কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ আর চূড়ান্ত অসহযোগিতার সমুচিত জবাব দেন এদেশের মানুষের অবিচল আস্থার প্রতীক, আশা-আকাক্সক্ষার শেষ আশ্রয়স্থল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ না করেই ২০১২ সালের ২৯ জুন বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে দেয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফেরার জন্য বিশ্বব্যাংককে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেয়া হয়।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রত্যাখ্যান করে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। ২০১২ সালের জুলাইয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি মূল সেতুর নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। ২০১৭ সালে কানাডার আদালত পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি মামলায় বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তথ্যকে অনুমানভিত্তিক, গালগল্প ও গুজবের বেশি কিছু নয় বলে রায় দেয়। বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হয়।
আনন্দবাজার/শহক