- জেলার চাহিদা মিটিয়ে নরসিংদী কোরবানি পশু যাবে দেশের বিভিন্ন হাটে
ঈদুল আজহা সামনে রেখে প্রতি বছরের মতো এবারও নরসিংদীতে সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে পশু মোটাতাজা করেছেন নরসিংদীর কৃষক ও খামারিরা। তবে গো-খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে পশু লালন-পালন খরচ বাড়ার কারনে কোরবানির পশুর দাম ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কায় আছেন খামারিরা। এদিকে, ভারতীয় গরু আমদানি না হলে এবছর কোরবানিন পশু বিক্রি করে কিছুটা লাভবান হবেন বলে জানিয়েছেন খামার মালিকরা। জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলায় কোরবানিযোগ্য পশুর চাহিদার বিপরীতে বেশি পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। যা জেলার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে এই কোরবানি পশু যাবে দেশের বিভিন্ন পশুর হাটে।
সরেজমিন ঘুরে জেলার বিভিন্ন খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসন্ন কোরবানির ঈদকে ঘিরে প্রতি বছরের মতো এবারও গরু-মহিষসহ কোরবানির পশু মোটাতাজাকরণ করা হচ্ছে। ঈদ ঘনিয়ে আসায় পশুর যত্নে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক ও গরুর খামারিরা। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে অনেকে ছয় থেকে ১১ মাস আগে দেশের পশুর বিভিন্ন হাট ঘুরে গরু, মহিষ ও ছাগল কিনে লালনপালন শুরু করেন। খামারীদের পাশাপাশি লাভের আশায় পারিবারিকভাবেও অনেক কৃষক গরু, ছাগল ও মহিষ মোটাতাজা করছেন। বিশেষ করে গরু মোটাতাজা করা হয়েছে দেশীয় খাবার খৈল, কুড়া, চালের খুদ, ছোলা, সয়াবিন, ভুষি, কাঁচা ঘাস ও খড় খাইয়ে। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক ও পশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কোনো ওষুধ তারা গরুকে খাওয়ান না। তবে গো-খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে পশুর লালন পালন খরচ বেড়েছে বলে জানান খামারিরা। কোন কোন খামারিরা খামার থেকেই ৪৮০টাকা কেজি ধরে বিক্রি করছেন কোরবানির পশু।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্য মতে, ঈদকে সামনে রেখে নরসিংদী জেলার ছয় উপজেলায় দেশীয় পদ্ধতিতে ছোট বড় ৭ হাজার ১৬৬জন খামারি ৬৫ হাজার ৪৭২টি কোরবানির পশু মোটাতাজা করছেন। নরসিংদীতে চাহিদা ৫৬ হাজার ৯০৯টি থাকলেও চাহিদার চেয়ে ৮ হাজার ৫৬৩টি বেশি পশু প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন তারা। এর মধ্যে ষাড় ২৫ হাজার ৮০৬টি, বলদ ৫ হাজার ২১৬টি, গাভী ৫ হাজার ৭৪টি, মহিষ ১ হাজার ৭৮০টি, ছাগল ১৯ হাজার ৫৯১টি ও ভেড়া ৭ হাজার ৯০৯টি। এর বাইরেও পারিবারিকভাবে আনুমানিক কয়েক হাজার কৃষক ১-২টি করে কোরবানির পশু গরু ছাগল মোটাতাজা করছেন।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্য মতে আরোও জানাযায়, নরসিংদী জেলায় ৭হাজার ১৬৬জন খামারিদের মধ্যে সদর উপজেলায় ৫৩০জন, রায়পুরা উপজেলায় ১৭৮১জন, বেলাব উপজেলায় ১২৪৪জন, পলাশ উপজেলায় ৬১১জন শিবপুর উপজেলায় ১০৭৬জন ও মনোহরদী উপজেলায় ১৯২৪ জন খামারি রয়েছেন। গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় গত বছর থেকে প্রায় ২হাজার খামারি কমে গেছে। তবে দেশীয় খাবার খাওয়ানো ও ক্ষতিকর ওষুধ প্রয়োগ না করায় কোরবানির পশুর হাটে বাজারে এসব গরুর চাহিদা থাকে বেশি। এবারের কোরবানির পশু নরসিংদী জেলার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন পশুর হাটে সরবরাহ করা হবে বলে আশ^াবাদী জেলা প্রাণিসম্পদ।
শিবপুর উপজেলার মুন্সেফের চর (ইটাখোলা) গ্রামের খামারি কিবরিয়া গাজী বলেন, গত বছর ৬০টি গরু মোটাতাজা করেছি। শ্রমিকের খরচ ও গো খাদ্যের খরচ দিয়ে এখন আর লাভবান হওয়া যায়না। তাই ‘আমার খামারে এ বছর ৩৫ গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে। সাধারণত আমার জমিতে চাষ করা কাঁচা ঘাস আর খড়, ভুসি ও কুঁড়া খাওয়াই। গত বছর ভুসির বস্তা ছিল তেরশ টাকা এবার এক বস্তা ভুসি ২৬শ থেকে তিনহাজার টাকা। দিন দিন পশুখাদ্যের দাম বাড়ার কারণে গরু পালনে খরচ বেড়েছে। কিন্তু গরুর এ বছর কম গরু লালন পালন করেছি। ঈদ উপলক্ষে যদি দেশের বাহিরের গরু চলে আসে তাহলে লোকসান গুনতে হবে এমন মনোভাব আসায় আমি এরমধ্যে ১৫/২০টা গরু বিক্রি করে দিয়েছি ।
রায়পুরার চরমধুয়া এলাকার গ্রীণ এগ্রো ফামর্স এর মালিক আহসান সিকদার বলেন, এ বছর ৭৫টি গরু লালন পালন করেছি। কিন্তু যেভাবে গো-খাদ্যের দাম বাড়ছে তাতে কোরবানির পশুর দাম ও বাজার পরিস্থিতি কী হয় এ নিয়ে শঙ্কায় আছি।
সদর উপজেলার কামারগাঁও এলাকার কামারগাওঁ এগ্রো এন্ড ডেইল এর মালিক সাইদুর রহমান শিমু বলেন,
কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য এগারো মাস আগে ২৫টি কিনে পালন করে মোটাতাজা করছি। গো খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে গরুর বাড়তি খরচ হয়েছে। যদি দেশের বাইরের গরু আমদানি বন্ধ থাকে তাহলে ন্যায্য মূল্যে এসব গরু বিক্রি করতে পারলে লাভবান হতে পারবো বলে আশা করছি।
নরসিংদী ডাংগা ইউনিয়নের হাম্বা ফার্ম এর ম্যানেজার মামুনুর রশিদ সুজন বলেন, আমরা এবছর ১৫০টি গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেছি। এখানকার গরুকে শতভাগ দেশিয় পদ্ধতিতে কাচা ঘাস ও দানাদার খাবার খাইয়ে লালন-পালন করেছি। আমাদের ফার্মের গরু ওজন দিয়ে বিক্রি করি যার মূল্য প্রতি কেজি ৪৮০টাকা করে। এখানে ৩২০ কেজি থেকে ৭শত কেজি গরু আছে। আমরা গতবার ফার্ম থেকেই শতভাগ গরু বিক্রি করেছি। এবারও ইতিমধ্যে ৩০ ভাগ বড় গরু বিক্রি করেছি আর ঈদ আসার আগে আমরা শতভাগ গরু বিক্রি করতে পারবো বলে আশ^াবাদী।
তিনি আরো বলেন, হাজারো মানুষের ভিড় ঠেলে হাটে গিয়ে কোরবানির জন্য গরু কেনা ঝামেলার। এই ঝামেলা এড়াতে অনেকই আমাদের খামার থেকে সরাসরি গরু কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন স্থানীয় লোকজন। তবে দেশের বাহিরে গরু যাতে এবার না আসতে পারে সেদিকে সরকার যদি দিকে সুনজর দেন তাহলে আমরা যারা খামারি আছি তারা খামার করে টিকে থাকতে পারবো। আর যদি অবৈধভাবে দেশের বাহির থেকে গরু আসে তা হলে খামারিরা লোকসানে মুখে পড়বে এবং দিনদিন খামারিরা পশু পালন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন।
নরসিংদী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. হাবিবুর রহমান খান বলেন, পশু মোটাতাজাকরণে ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহার বন্ধে খামারগুলোতে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। তাছাড়া জেলার সকল খামারিদের সাথে আমরা নিয়মিত যোগাযোগের পাশাপাশি খামারিদের সচেতন ও তদারকি করছি। মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহার না করে দেশীয় খাবার খাইয়ে পশু মোটাতাজা করার জন্য কৃষক ও খামারীদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে গেল বছর দশ হাজার খামারি থাকলেও এবছর নরসিংদীতে প্রায় আট হাজার খামারি দেশীয় পদ্ধতিতে ৬৫হাজার পশু মোটাতাজা করছেন। আমরা আশ্বাবাদী ‘ঈদকে সামনে রেখে এবার নরসিংদীতে ১শত ৯৫কোটি টাকার পশুর বাজার সৃষ্টি হবে। এছাড়াও ঈদ উপলক্ষে প্রতিটি গরু হাটে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য মনিটরিং সেল বসানো হবে বলেও জানান তিনি।