ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাথররাজ্যে অর্থনীতির ফুল

পাথররাজ্যে অর্থনীতির ফুল

নির্মাণ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে গুণে ও মানে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃত সিলেটের পাথর কোয়ারির পাথর। প্রাকৃতিগতভাবেই পাহাড় থেকে লাখ লাখ টন পাথর নেমে এসে কোয়ারি অঞ্চলগুলোতে সঞ্চিত হতে থাকে। এসব কোয়ারি থেকে উত্তোলন করা পাথর দশকের পর দশক ধরে দেশের নির্মাণ শিল্পে যোগান দিয়ে আসছেন শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা। এসব কাজে জড়িয়ে রয়েছেন অন্তত ১০ লাখ মানুষ।

তবে পরিবেশ ধ্বংস করে সিলেটের একাধিক পাথর কোয়ারি থেকে পাথর আহরণ, উত্তোলনের ফলে সেটি বন্ধ করতে বছরখানেক আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশের আলোকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় পাথর উত্তোলন। ২০১৮ সাল থেকে বিভিন্ন কোয়ারি থেকেও পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে রয়েছে। পাশাপাশি ২০১৪ সালে উচ্চ আদালত সিলেটের সব পাথর কোয়ারিতে যন্ত্রের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ফলে পাথর উত্তোলন, বিপণন ও পরিবহনখাতে জড়িত সিলেটের পাঁচ উপজেলার ১০ লাখের বেশি মানুষ পড়েন চরম বিপাকে। বেকার হয়ে পড়েন হাজার হাজার শ্রমিক ও ক্ষুদ্র্র ব্যবসায়ী। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পাথর ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া বেশিরভাগ ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে পড়েন।

এই অচলাবস্থার মধ্যে কয়েক মাস আগে মন্ত্রণালয়ের সেই আদেশ ৬ মাসের জন্য স্থগিত ও সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনসহ বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। এসময় আশায় বুক বাঁধেন লাখ লাখ পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিক। তারা আশা করছিলেন, উচ্চ আদালতের আদেশ ও নির্দেশনায় দীর্ঘদিন পর হলেও করোনার প্রভাব মোকাবিলায় মানুষের আয়-রোজগারের পথ সুগম হবে। কিন্তু তাদের সেই আশার প্রতিফলন ঘটেনি। উচ্চ আদালতের সেই আদেশ-নির্দেশনা পরবর্তীতে স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে তাও স্থগিত করা হয়। ফলে আবার দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে পাথর কোয়ারি চালু প্রক্রিয়া।

এবার সিলেটের সেসব পাথররাজ্যের দুয়ার খুলতে চায় সরকার। সিলেট জেলা প্রশাসককে গত ৬ জুন এ বিষয়ক কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার লোভা নদীর দু’পাড়ে জব্দ প্রায় এক কোটি ঘনফুট পাথর আদালতের রায়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলে তা নিলামে বিক্রি করতে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং সিলেট জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। আদালতের আদেশ মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। পাথর কোয়ারি, পাথর উত্তোলন, খাস আদায় এবং জব্দ পাথর উন্মুক্ত নিলামের বিষয়ে দায়ের করা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।

গত ২ জুন সিলেট বিভাগের সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসককেএ বিষয়ক চিঠি প্রদান করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বলছে- অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজে প্রধান কাঁচামাল পাথর। প্রাকৃতিগতভাবে পাওয়া এই পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখলে দেশের চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে গত ৩১ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভার কার্যপত্রে বলা হয়, পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট বিরূপ প্রভাব ও উত্তোলন বন্ধের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার সচিবের নেতৃত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়।

পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার সচিবের নেতৃত্বে একটি উপ-কমিটি ২০২০ সালের ২৯ ও ৩০ আগস্ট সিলেট জেলার পাথর কোয়ারিগুলো পরিদর্শন করেন। পরে সেই কমিটি গত বছরের ১৫ জুলাই ১৩টি সুপারিশসহ বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের কাছে জমা দেন। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ৩১ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সেই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিলেট জেলা প্রশাসক, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য, নৌ-পরিবহন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো এবং বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, পরিবেশগত ক্ষতি, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাহিদা ও জোগান, আমদানি সম্ভাব্যতা এবং আর্থিক বিষয়গুলো বিবেচনায় কৃষি জমি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বিদ্যমান গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারিগুলো পুনরায় ইজারা প্রদান করা যাবে কি না তা যাচাই করার লক্ষে জিওগ্রাফিক্যাল সার্ভে এবং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হলো। এ কমিটিতে ভূমি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য, বেসাময়িক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন, পানি সম্পদ মন্ত্রণায়, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিলেট বিভাগীয় কমিশনার, খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো এবং বাংলাদেশ তাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, গঠিত এ কমিটি গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারিগুলোর মজুত পাথরের পরিমাণ, উত্তোলনযোগ্য পাথরের পরিমাণ, উত্তোলনের সময়কাল, পাথর কোয়ারির এলাকার পরিবেশ, নদীর নাব্যতা সঙ্কট বিবেচনায় মানব স্বাস্থ্য, কৃষি, ইকো-সিস্টেম, মৎস্য ও জীব-বৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশ বিবেচনা করে পাথর কোয়ারির তালিকা হালনাগাদ করবে। এই কমিটিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আরো সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে। তা আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এছাড়া পাথরভাঙার জন্য সিলেট জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ, গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং এবং সুনামগঞ্জ জেলার তাহেরপুর উপজেলায় একটি ক্রাশার জোন শিল্প মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে স্থাপনের উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে স্টোন ক্রাশিং মেশিন স্থাপন নীতিমালা ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) এর প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধন আনা যেতে পারে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পাথর কোয়ারির সঙ্গে সম্পৃক্ত মহিলা শ্রমিকদের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আয়বর্ধক প্রকল্পের মাধ্যমে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শ্রমআইন ২০১৬-এর আওতায় পাথর শ্রমিকদের জন্য নতুন বিধিমালা এবং নীতিমালা প্রণয়নের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তর প্রচলিত বিধিবিধানের আলোকে পাথর কোয়ারি জন্য পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা ইআইএ-এর একটি জেনেরিক টিওআর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইডে দিতে পারবে এবং ইআইএ সম্পাদন সংক্রান্ত আবেদনটি অতিদ্রুত নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে।

এর আগে গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সহকারী সচিব মাতোয়ারা বেগম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি আসে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কাছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই চিঠিতে ৬ দফা সুপারিশ করা হয়। এতে কোয়ারি ইজারা দেওয়া যেতে পারে বলে মতামত দেওয়া হয়।

সুপারিশগুলো ছিলো- পাথর উত্তোলনে অনুমতি দেওয়া হলে উত্তোলনের ফলে তৈরি হওয়া গর্তগুলো ভরাট করা, ইতোপূর্বে পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট গর্ত ভরাট ও বনায়ন করা, হাজার হাজার পাথর শ্রমিকের বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে শিল্প-কারখানা স্থাপন ও পর্যটন শিল্পের বিকাশ, জাফলং ও ভোলাগঞ্জে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া ও নিয়মিত টাস্কফোর্সের অভিযান অব্যাহত রাখা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন