দেশের অর্থনীতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বাজেটের আকার। আবার বিশ্বকে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপি। তলাবিহী ঝুড়ি থেকে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে এসেছে দেশ। গত ৫০ বছরে ৫২টি বাজেটে আকার বেড়েছে ৭৭ হাজার ৩৩৬.৩৮ শতাংশ টাকা।
বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তিনটি। দেশের প্রথম টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেট দেন ডক্টর এ আর মল্লিক। এ এম এস কিবরিয়া ছয়টি, এম সাইদুজ্জামান চারটি বাজেট দেন। অর্থ-উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম দুটি এবং ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একটি বাজেট পেশ করেন। এরশাদ সরকারের দুই অর্থমন্ত্রী এম এ মুনিম দুটি এবং ড. ওয়াহিদুল হক একটি বাজেট উপস্থাপন করেন। বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ড. মির্জা নুরুল হুদা একটি বাজেট দেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটটি ছিল বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমের সংখ্যা মান। অর্থাৎ বিসমিল্লার অক্ষরগুলোকে সংখ্যা দিয়ে হিসেব করলে অঙ্ক দাঁড়ায় ৭৮৬। পৃথিবীতে এক মাত্র বাংলাদেশেই এমন একটি বাজেট ঘোষণা করা হয় ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। অবশ্য তার বাজেটটি ছিল মূলত ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট।
অবশ্য তার আগে মুক্তিযুদ্ধচলাকালে প্রথম বাজেটটি দিয়েছিল মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রীর এম মনসুর আলী। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের অনুমোদনে দেয়া বাজেটের ব্যাখ্যামূলক টীকায় বলা ছিল, আমাদের এখন স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য দরকারি, অপরিহার্য ব্যয় মেটাতে বাজেট তৈরি করতে হচ্ছে। যেটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধ প্রক্রিয়ায় সাহায্য করবে। বাজেট জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এই তিন মাস সময়ের জন্য তৈরি করা হয়েছে। বাজেট বরাদ্দ তৈরিতে কোন বাস্তব (নিরীক্ষা) ছিল না। সেই বাজেটে আয় ধরা হয়েছিল ৭ কোটি ৭৪ লাখ ১৮ হাজার ৯৯৮ টাকা, ব্যয় ধরা হয় ৮ কোটি ৬২ লাখ ৪৮ হাজার ২০৪ টাকা। ফলে বাজেট ঘাটতি ছিল ৮৮ লাখ, ২৯ হাজার ২০৬ টাকা। তবে এই বাজেটকে দেশে স্বীকৃতি পাওয়া যায় না বাজেটের নথিপত্রে।
মূলত ১৯৭২ সালের ৩০ জুন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাজেটটিকেই প্রথম হিসেবে গণনা করা হয়। তিনি একই সঙ্গে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ের ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেটের শুরু ছিল ১ জুলাই ১৯৭২ সাল থেকে, শেষ ৩০ জুন ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত দুটিকে এক সঙ্গে মিলিয়ে একটি বাজেট দেন। তার পর ১৪ জুন ১৯৭৩ সালে ৯৯৫ কোটি টাকা ও ১৯ জুন ১৯৭৪ সালে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের জন্য ১০৮৪.৩৭ কোটি টাকার বাজেট দেন। ওই বাজেটের আয়-ব্যয়ের হিসাব ছিল একটি ভিন্ন ধরনের। যেমন, রাজস্ব আয় ধরা হয়েছিল ২৮৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, এবং ব্যয় ২১৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। আবার উন্নয়ন, পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসন বাজেট ঠিক করা হয়েছিল ৫০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি ছিল ৩১৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
পঞ্চাশ বছরে দেশের বাজেটের আকার বেড়েছে ৭৭ হাজার ৩৩৬.৩৮ শতাংশ। দেশের প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। আর ১৯৮২-৮৩ অর্থবছরে ছিল ৪,৭৩৮ কোটি টাকা। সে হিসেবে প্রথম ১০ বছরে বাজেট বৃদ্ধি পায় ৬০২.৭৯ শতাংশ। ১৯৯২-৯৩ বাজেট ছিল ১৭,৬০৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে দ্বিতীয় ১০ বছরে বৃদ্ধি পায় ৩৭১.৬১ শতাংশ। ২০০২-০৩ অর্থবছরে বাজেট ছিল ৪৪,৮৫৪ কোটি টাকা। এই তৃতীয় ১০ বছরে বৃদ্ধি পায় ২৫৪.৭৫ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাজেট ছিল ১,৯১,৭৩৮ কোটি টাকা। এই চতুর্থ ১০ বছরে ৪২৭.৪৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয় ৬০৭৮৬৪ কোটি টাকা। সে হিসেবে পঞ্চম ১০ বছরে বাজেট বেড়েছে ৩১৭.০২ শতাংশ। আর ৫০ বছরে বাজেট বেড়েছে ৭৭ হাজার ৩৩৬.৩৮ শতাংশ।
দেশভেদে বাজেট পেশের সময় বিভিন্ন দেশে ভিন্ন হয়ে থাকে। বাংলাদেশে যেমন জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে, সাধারণত জুন মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার। এবার জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাজেট পেশ হতে যাচ্ছে। পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশের অর্থবছর শুরু পহেলা জুলাই, শেষ ৩০ জুন। চীন, ব্রাজিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্পেনে অর্থবছর শুরু হয় পহেলা জানুয়ারি আর শেষ হয় ৩০ ডিসেম্বর। ভারত, ইংল্যান্ড, হংকং, কানাডা ও দক্ষিণ আফ্রিকায় অর্থবছর শুরু হয় পহেলা এপ্রিল, শেষ হয় ৩১ মার্চ। যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডে অর্থবছর শুরু হয় পহেলা অক্টোবর, শেষ হয় ৩০ সেপ্টেম্বর।
তবে এটি পরিবর্তন করে জানুয়ারি বা এপ্রিলে নিয়ে আসার প্রস্তাব করেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ। মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটস এটি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি অথবা মার্চ-এপ্রিলে আনার প্রস্তাব করেন। তা ছাড়া বর্তমান পদ্ধতিতে বাজেটের বই মুদ্রণ না করে অর্থমন্ত্রী হাজার খানেক খসড়া বাজেট ছাপিয়ে সংসদে পেশ করবেন। পরবর্তীতে আলাপ-আলোচনার পর যা নির্ধারণ হবে সে অনুযায়ী বই ছাপানো।
আনন্দবাজার/টি এস পি