- তরুণ বিজ্ঞানী—
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলায় প্রথম বারের মত একটি হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট এর জন্য হোটেল বয় হিসাবে কাজ করবে এ রোবট। রোবট তৈরির এমন খবরে পুরো এলাকায় জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। রোবটটিকে দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনও বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা হাবিবের বাড়িতে ভীড় জমান। রোবট দেখতে পেয়ে এলাকার মানুষ আনন্দিত।
সরেজমিনে আহসান হাবিবের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির আঙিনায় রোবট চিট্টির প্রদর্শনীর করছেন নির্মাতা হাবিব। চারপাশে উৎসক জনতার ভিড়। হাবিব একের পর এক প্রশ্ন করছে আর চিট্টি ইংরেজিতে জবাব দিচ্ছে। নির্দেশনামতো এদিক-ওদিক ঘুরছে। সামনে-পেছনে মুভ করছে। হাত বাড়িয়ে দিলে করমর্দনও করছে চিট্টি।
রোবটটির নির্মাতা ও কারিগর হল কালীগঞ্জ সরকারী করিম উদ্দিন পাবলিক কলেজের এবার এইচএসসি পরীক্ষার শিক্ষার্থী আহসান হাবিব (১৮)।
সে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার তুষভান্ডার ইউনিয়নের সুন্দ্রাহবি গ্রামের মৃত মজু মিয়া খালেদা বেগমের ছেলে। পরিবারে দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে আহসান হাবিব সবার ছোট। জায়গা জমি বলতে বাড়ি ভিটে তিন শতক জমি। বড়ভাই খাইরুল ইসলাম একজন ট্রাক চালক।
আহসান হাবিব ইউটিউবে ভিডিও দেখে মাত্র সাত মাসের প্রচেষ্টায় দেড়লাখ টাকা খরচ করে রোবটটি বানাতে সক্ষম হয়েছে।
রোবটির নাম রাখা হয়েছে চিট্টি। সে বাংলা ও ইংরেজি দু ভাষায় যেকোনো প্রশ্নের সাবলীল উত্তর দিতে পারে। চলাচল করে মানুষের মতই। মানুষের দেহের গঠনের সঙ্গে মিল, হালকা ভারী কাজ করতে সক্ষম, মানুষের ছবি ও কথা রেকড রাখতে পারা, হ্যান্ডশেক ও অঙ্গভঙ্গিও করতে পারা এ রোবটি বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিখাতে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতেই রোবট টিকে তৈরি করা হয়েছে বলে জানালেন এর তরুণ নির্মাতা আহসান হাবিব।
জানা গেছে, কালীগঞ্জ উপজেলার সুন্দ্রাহবি গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া আহসান হাবিব নতুন কিছু আবিস্কারের স্বপ্ন দেখতো বাল্যকাল থেকেই। কিন্তু বাবা দরিদ্র কৃষক থাকায় তার প্রতিভাকে সঠিকভাবে প্রস্ফুটিত করতে পারছিলো না সে। ভাগ্য তার প্রতি সুপ্রসন্ন ছিল ২০১৭ সালে আহসান হাবিব তুষভান্ডার রমণীকান্ত মেমোরিয়াল সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয় পড়ার সুবাদে সে স্কুলের ফান্ডের টাকায় বিজ্ঞান মেলা উপলক্ষে একটি রোবট বানানোর সুযোগ পেয়ে সে লালমনিরহাট জেলা পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকার করে।
২০১২ সালে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী দরিদ্র পিতা মজু মিয়াকে হারিয়ে তার জীবনে আধাঁ ঘনিয়ে আসতে শুরু করে। পিতাকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে আহসান হাবিব। থেমে যায় তার স্বপ্ন, লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খায় হাবিব। শুরু হয় তার কঠিন জীবন সংগ্রাম। তবুও দিশেহারা হয়ে পড়েনি এ স্বপ্নবাজ যুবক। প্রতিদিন সকাল ৬ টা হতে রাত ১২ টা পযন্ত সে মোট ১২ টি টিউশনি করেই নিজের পরিবার ও লেখাপড়ার খরচ যুগিয়ে চলেছে। টিউশনির সামান্য সঞ্চয় ও ধার দেনা করেই এবার সে একটি হোটেলের জন্য এ রোবটটি তৈরি করেন।
রোবটটি উপজেলার তুষভান্ডার রওশন ফিলিং স্টেশন সংলগ্ন ভোজন বিলাস হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট এর জন্য তৈরী করা হয়েছে। যা এ সপ্তাহেই উক্ত হোটেলে রোবটটি ডেলিভারী করা হবে বলে জানান হাবিব।
এ বিষয়ে রোবট নির্মাতা আহসান হাবিব জানান,আমি স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় জেলার প্রথম হয়েছি। সেই উৎস থেকে আমি রোবট বানানো চেষ্টা করি। আমি মুলত ইউটিউব দেখেই এ কাজে আমি আগ্রহী হই।
তিনি আরও বলেন, এ কাজে আমি আমার মা,বড়ভাই, চাচা সবার আন্তরিক সহযোগিতা সব সময় পেয়েছি। আমার এ কাজে আমাকে সবসময় সহযোগিতা করেছে আমার বন্ধুরা। পাশাপাশি সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন তরুণ উদ্যোক্তা আহসান হাবিব। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা একটু নজর দিলে আমি আরও ভাল কিছু বানাতে পারব।
হাবিবের মা খালেদা খাতুন বলেন, আমার ছেলের এমন কাজে আমার খুব ভাল লাগছে। গ্রামের মানুষ আমার ছেলেকে পাগল বলেছিল কিন্তু না সে একটি রোবট বানিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমার ছেলে। এতে আমি আনন্দিত। তিনি আরও বলেন, আমরা গরিব মানুষ। আমার ছেলে হাবিবকে যদি সরকার সহযোগিতা করেন তাহলে আমার ছেলে আরও এগিয়ে যাবে।
প্রতিবেশী সাজু মিয়া (৫০)বলেন,আমার গ্রামের ছেলে একটা রোবট বানাইছে আমার দেখি খুব খুশি হয়েছি। সেটা কথা বলে আর হ্যান্ডশেক করে।
প্রতিবেশি মজনু মিয়া (৪০) বলেন, দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া হাবিবের এ কাজে গ্রামের সবাই আমরা ধন্য। তার এ কাজে আমাদের গ্রামের সুনাম ও সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছে।
তুষভান্ডার বিদ্যা নিকেতনের শিক্ষার্থী রাইফো ইসলাম বলেন, আমাদের হাবিব ভাই একটি রোবট তৈরি করেছে তাই আমরা সকল শিক্ষার্থী রোবটি দেখতে তার বাড়িতে এসেছি দেখে আমরা অনেক আনন্দিত।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, রোবট তৈরির বিষয়টি জেনেছি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ফলে তরুণ উদ্যোক্তারা এগিয়ে যাচ্ছে। খোঁজখবর নিয়ে ওই তরুণ উদ্যোক্তা কে সরকারি ভাবে সহযোগিতা করা হবে।
তুষভান্ডার রমনীমোহন মেমোরিয়াল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নলিলি কান্ত রায় বলেন, ‘আহসান হাবিব ২০১৭ সালে বিজ্ঞানমেলায় লালমনিরহাট জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করে। তখন থেকে সে রোবট বানানোর ওপর ঝুঁকে পড়েছে। অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও একটি রোবট তৈরি করেছে। সবার সহযোগিতা পেলে সে আরও এগিয়ে যাবে।’
এ বিষয়ে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানান, রোবট তৈরির বিষয়টি তার জানা নেই। তিনি বিষয়টি খোঁজ নেবেন।