ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিরূপ জলবায়ুতে রোগব্যধির হানা

সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা। যারা ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড়ো শহরের বাসিন্দা। পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে শুকনো মৌসুমে এসব শহরে বাড়ছে শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যাতে মূলে রয়েছে বায়ুদূষণ।
  • বাড়ছে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি
  • বাতাসে পলিউশন, খাবারে পলিউশন, দূষিত খাবার, দূষিত পানিসহ নানা কারণে অসংক্রামক ব্যধি হচ্ছে: জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্যমন্ত্রী

জলবায়ু বদলে যাওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। বিরূপ প্রভাব পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা। যারা ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড়ো শহরের বাসিন্দা। পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে শুকনো মৌসুমে এসব শহরে বাড়ছে শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যাতে মূলে রয়েছে বায়ুদূষণ।

২০২১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের ‘জলবায়ুর দুর্ভোগ’ বা ‘ক্লাইমেট অ্যাফ্লিকশন’ গবেষণাপত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্ব ব্যাংক ১৯০১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের আবহাওয়া, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের তথ্য বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি ২০১৯ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর এবং ২০২০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের শহর ও গ্রাম এলাকার ৩ হাজার ৬০০ খানার ওপর জরিপ পরিচালনা করেছে।

জরিপে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে মানুষের শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি থাকে এবং অপরদিকে আর্দ্রতা ১ শতাংশ বাড়লে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ধরা পড়ার আশঙ্কা ১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে যায়।

গবেষণায় জানানো হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে এবং অবস্থার সর্বোচ্চ অবনতির ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়, তাহলে স্বাস্থ্য সমস্যা এতটাই প্রকট হবে যে পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার ধারণাটি কোনো কাজে আসবে না।

গবেষণা মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। আর ২১০০ সাল নাগাদ তা বেড়ে যেতে পারে ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত। ২০৪০ থেকে ২০৫৯ সালের মধ্যে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে দাড়াতে পারে ৭৪ মিলিমিটার পর্যন্ত।

এদিকে, গেল কয়েক বছর ধরে সারাবিশ্বেই অসংক্রামক রোগবালাই অপ্রতিরোধ্যভাবে বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা। ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, স্থায়ী বক্ষব্যধি, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, স্নায়ুবিক উচ্চরক্তচাপসহ নানা অসংক্রামক রোগে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। যাদের বয়স ৩০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন ও হেলথ বুলেটিন ২০১৫ এর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) বুলেটিন অনুযায়ী ৬১ শতাংশ মানুষ অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত। গত ৫ বছরে তা ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দূষণ, লাইফস্টাইল ও খাদ্যভ্যসের জন্যও অসংক্রামক রোগগুলো বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়, মোবাইল-কম্পিউটার বা টেলিভিশনের স্ক্রিন বেশি দেখার কারণে মানসিক সমস্যা বাড়ছে। এটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা। এ কারণে হাসপাতালে বেশ চাপ পড়ে, আত্মহত্যাও বাড়ছে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ‘প্রথম ইন্টারন্যাশনাল এনসিডিস কনফারেন্স-২০২২ বাংলাদেশ’ বিশেষজ্ঞরা জানান, অসংক্রামক রোগই বাংলাদেশের জন্য ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যঝুঁকি ও উদ্বেগের কারণ। ৬৭ শতাংশ মৃত্যুর জন্য এটি দায়ী। দেশের ২০ শতাংশ মানুষ উচ্চরক্তচাপ, ১০ শতাংশ ডায়াবেটিস ও ২০ লাখ মানুষ ক্যানসারে ভুগছে। প্রতিবছর ৫০ হাজার যোগ হয়। জীবনযাত্রার পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, স্থূলতা, তামাকের ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ, অপর্যাপ্ত কায়িক পরিশ্রম, ওষুধের অপব্যবহারের কারণে অসংক্রামক রোগ বাড়ছে।

প্রথম জাতীয় অসংক্রামক রোগ সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক ডা. শামীম হায়দার তালুকদার জানান, ৩৫ বছরের ওপরে ৫০ শতাংশ মানুষের উচ্চরক্তচাপ আছে। দেশে উচ্চরক্তচাপ ডায়াবেটিস, ক্যান্সারসহ কয়েকটি রোগে ৭০ শতাংশ মানুষ মারা যান। যারা অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত, তাদের চিকিৎসা নিশ্চিতের পাশাপাশি প্রতিরোধের ওপর জোর দিতে হবে। প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আলিয়া নাহিদ বলেন, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ১০০ জনের মধ্যে ৫০ জন জানে না তাদের উচ্চরক্তচাপ আছে। তিনি বলেন, ৩০ বছর বয়সের পর থেকে প্রতিবছর একবার করে অন্তত স্ক্রিনিং করতে হবে। স্ক্রিনিংয়ের মধ্যে শরীরের ওজন, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা করতে পারলে ভালো। শরীরের মেদ, লবণ ও চিনি বেশি পরিমাণে খাওযা, বসে বসে কাজ করা, মানসিক চাপে ভোগেন, খেলাধুলা করেন না, প্রতিদিন নিয়মিত ৩০ মিনিটের কম হাঁটাচলা করে এমন ব্যক্তিদের প্রতিবছর একবার করে স্ক্রিনিং করার পরামর্শ দেন তিনি। এসব উপসর্গ যাদের মধ্যে আছে, তারা অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিতে থাকেন।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, হৃদরোগের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। যেখানে ২০০৯ সালে এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখ ৬০ হাজার ৮ জন সেখানে ২০১৪ সালে বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ২ লাখ ৫৩৩ জন মানুষ।

অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে আর্য়ুবেদ অ্যান্ড ন্যাচারোপ্যাথি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ডা. সমীর কুমার সাহা বলেন, আমাদের লাইফস্টাইল এবং খাদ্যাভাস এই অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাওয়ার জন্য প্রধান দায়ী। খাদ্যাভাস আগে বাংলাদেশে যে রকম ছিল তার থেকে অনেক বদলে গেছে। বর্তমান সময়ে ফাস্টফুড, রিচফুডসহ রাস্তার ধারের পোড়া তেলের খাবার আমাদের শরীরের যে ক্ষতি করে সেটাই এই রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবার প্রমাণ। আমাদের কায়িক পরিশ্রম কম। জীবন যাপনে নানামুখি চাপ বেড়ে গেছে এখন। আমরা পরিশ্রম করি কম। কিন্তু খুব সহজেই দিনের তিন বেলাতেই রিচ ফুড খেয়ে যাচ্ছি, কায়িক পরিশ্রম হয় না। কিন্তু শরীর তো মেশিন না, তার জন্য সঠিক খাদ্য দরকার। সেটা আমরা নিচ্ছি না। অপরদিকে শাকসবজি যতোটা খাচ্ছি সেখানেও কেমিক্যাল খাচ্ছি। এসব কারণেই মূলত অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বাতাসে পলিউশন, খাবারে পলিউশন, দূষিত খাবার, দূষিত পানি নানা কারণে আমাদের এই অসংক্রামক ব্যধিগুলো হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি আছে আমরা কায়িক পরিশ্রম করি না বসে বসে কাজ করি। যার ফলে আমাদের নানান অসংক্রামক ব্যধির সৃষ্টি হয়। মানুষ যদি সচেতন হয় তবেই এইসব অসংক্রামক ব্যধি নির্মূল করা যেতে পারে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন