প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা। দ্বিপাক্ষিক স্থলবাণিজ্যের আকার প্রায় এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। ইতোমধ্যে ভারতের স্থলভাগ ব্যবহার করে ভুটান ও নেপালও বাংলাদেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম শুরু করেছে। দেশের অর্থনীতি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থলবাণিজ্যের যেমন প্রসার ঘটছে, তেমনি গুরুত্বও বাড়ছে। দেশের স্থলবাণিজ্য নিয়ে দৈনিক আনন্দবাজারের বিশেষ আয়োজনে আজ নীলমফামারীর চিলাহাটি স্থলবন্দর নিয়ে জেলা প্রতিনিধি এস এ প্রিন্সের পাঠানো প্রতিবেদন- ফাইলবন্দি বাণিজ্যের স্বপ্ন।
শিল্পায়নের ছোঁয়ায় দিন দিন বদলে যাওয়া উত্তরাঞ্চলের সমৃদ্ধ জেলা নীলফামারীর চিলাহাটিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে স্থলবন্দর। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট স্থলবন্দর সম্পর্কিত গেজেট প্রকাশিত হলেও গত প্রায় এক দশকে বাস্তবায়ন হয়নি। স্থলবন্দরটি চালুর অপেক্ষায় দিন গুণছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তাসহ সব শ্রেণির মানুষ।
জেলা সদর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার উত্তরে ডোমার উপজেলার ভোগডাবুড়ি ইউনিয়নে চিলাহাটির অবস্থান। ব্রিটিশ আমলে এটি ছিল প্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র। সে সময় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এর মধ্যে অন্যতম শুল্ক স্টেশন ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট। বর্তমানে চিলাহাটিতে রয়েছে একটি রেলওয়ে স্টেশন, দুটি সরকারি ব্যাংক, সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার, পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ক্যাম্পসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
আরও পড়ুন-
শুধু তাই নয়, উত্তরাঞ্চলের মধ্যে নীলফামারী জেলা হয়ে উঠেছে এখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বড় একটা কেন্দ্র। উত্তরা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (উত্তরা ইপিজেড), দারোয়ানি টেক্সটাইল মিল, ছয়টি পাটকল, তিনটি সিরামিক কারখানা ও বেশ কিছু পোশাক কারখানা বদলে দিয়েছে এই এলাকার জীবন ও পেশা। শুধু নীলফামারীই নয়, পাশের জেলাগুলোতেও গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিল্পকারখানা।
উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিলাহাটিতে স্থলবন্দর স্থাপিত হলে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের পাশাপাশি থাকা অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরা রাজ্যসহ (সেভেন সিস্টার রাজ্য) সার্কভুক্ত নেপাল, ভূটান আর চীনের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে যোগ হবে এক নতুন মাত্রা। উত্তরা ইপিজেডসহ দেশের অন্যান্য ইপিজেডে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠবেন দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীরা। প্রসার ঘটবে ব্যবসা বাণিজ্যের। ঘুচবে বেকারত্ব। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির ফলে দেশ হবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। এসব কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক প্রভাবে দ্রুত পাল্টে যাবে উত্তরাঞ্চলের চিত্র।
স্থানীয়দের দাবি, বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের মধ্যে অনেক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও স্থলবন্দর স্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। চিলাহাটিতে স্থলবন্দর স্থাপন হলে এটিই হবে সার্কভুক্ত পার্শ্ববর্তী চার দেশের গেটওয়ে। সরকার চাইলেই এই রুটে সার্কভুক্ত সাতটি দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।
দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ দশক পর ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর চিলাহাটী থেকে ভারতের নিউ জলপাইগুঁড়ি পর্যন্ত রেলপথে পণ্যপরিবহন সেবা চালু হয়। পরের বছরের ২৭ মার্চ থেকে শুরু হয় যাত্রীবাহী রেল যোগাযোগ। এখন রেলপথে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য সমৃদ্ধ করতে জরুরি হয়ে পড়েছে স্থলবন্দর স্থাপন।
আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিলাহাটিতে স্থলবন্দর স্থাপিত হলে খুব দ্রুত ও স্বল্প ব্যয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা সম্ভব হবে। সৈয়দপুর নোয়া গ্রুপের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর রাজ কুমার পোদ্দার দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে পরিবহন ব্যয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চিলাহাটি থেকে ভারতের হলদিবাড়ী রুটে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলে সুবিধা থাকলেও রেলপথে পণ্য পরিবহন ব্যয় সড়ক পথে পণ্য পরিবহন ব্যয় থেকে অনেক বেশি। ফলে চিলাহাটি স্থলবন্দর চালু হওয়া ছাড়া ব্যবসায়ী মহল উপকৃত হবেন না।
সৈয়দপুর নুর ট্রেডার্সের প্রোপাইটর নুর ইসলাম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, সরকারের ঘোষণা থাকলেও চিলাহাটি স্থলবন্দরটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা দর্শনা, সোনা মসজিদ, বেনাপোল, হিলি ও বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করছেন। এতে ব্যয় বাড়ে অনেক বেশি। স্থলবন্দরটি বাস্তবায়ন হলে উত্তরাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।
নীলফামারীর সাইকেল গার্ডেনের স্বত্বাধিকারী এস এম গোলাপ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকে চিলাহাটি স্থলবন্দর স্থাপনের কাজ আটকে আছে। পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর স্থাপিত হলে সড়ক পথে স্বল্প খরচে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করে ছোট বড় সব ব্যবসায়ী সুফল পাবে।
নীলফামারী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি প্রকৌশলী এসএম শফিকুল ইসলাম ডাবলু দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, প্রায় ১১ বছর আগে তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান খান চিলাহাটীতে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর স্থাপনের ঘোষণা দিলেও আজ অবধি তা বাস্তবায়ন হয়নি। পরে ২০১৩ সালে গেজেট হয়েছে। এটি স্থাপিত হলে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক সর্বোচ্চ মাত্রায় স্থান পাবে।
নীলফামারী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার তৎকালীন নীলফামারীতে উত্তরা ইপিজেড স্থাপন করেছে যা জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী জেলায় একটি আইটি পার্ক, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বিভিন্ন কল কারখানা গড়ে উঠছে। কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সমাজ সেবা অধিদপ্তরসহ সরকারি পৃষ্ঠ পোষকতায় বিভিন্ন দপ্তরে দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে। এই অঞ্চলের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে চিলাহাটি স্থলবন্দর বাস্তবায়ন করতে এলাকাবাসীর পক্ষে সরকারের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
নীলফামারী জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, চিলাহাটিতে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর বাস্তবায়নে সম্ভাবতা যাচাইয়ে ইতোমধ্যে কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করেছে বলে জেনেছি। খুব শিগগিরই স্থলবন্দর বাস্তবায়নে আমাদেরও সদিচ্ছা রয়েছে। চিলাহাটি স্থলবন্দর বাস্তবায়ন হলে ভারতের সেভেন সিস্টার খ্যাত সাত রাজ্যসহ নেপাল আর ভূটানের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের এক নবদিগন্তের সূচনা হবে।
আনন্দবাজার/শহক