নওগাঁ সদরের বর্ষাইল গ্রামের সবজি চাষি আব্দুস সোবহান। মৌসুম ভেদে প্রায় সব ধরনের সবজিই চাষ করেন। নিজের জমি বেশি না থাকায় লিজ নিয়ে ১০ বিঘায় বেগুন, করলা, ঢ্যাঁড়স, পটলসহ বিভিন্ন রকমের শাক চাষ করেছেন। এর মধ্যে ১৮ শতক জমিতে বেগুন লাগিয়েছেন। রমজানে বাড়তি চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই সোবহান বেগুন রোপন করেন। হাড়ভাঙা খাটুনির পর জমিতে সবজির ভালো ফলন দেখে তার চোখ খুশিতে নেচে ওঠে। তবে সবজি তোলার পর বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে চরম হতাশ হয়ে পড়েছেন। উৎপাদন খরচ কোনোমতে হাতে এলেও লাভের মুখ আর দেখা হয়নি। অথচ তার উৎপাদন করা বেগুন খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দামে।
বর্ষাইল গ্রামেরই আরেক চাষি শরিফুল ইসলাম সবজি চাষ করে হতাশ। তিনি দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি বেগুন পাইকারি দরে ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি দামে। কখনও ৭০-৮০ টাকা দরে। বেগুন যারা চাষ বা উৎপাদন করছেন তারা লাভ পাচ্ছে না। সব লাভই চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী পাইকারি ব্যবসায়ীদের পকেটে।
বদলগাছীর পারশোমবাড়ী গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, সারাদিন আমরা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে চাষ করছি আর লাভ খাচ্ছে এক শ্রেণি অসাধু ব্যবসায়ী। আমরা সবজির বীজ কিনে রোপণ করছি, সার-কীটনাশক দিচ্ছি নিয়মিত। ক্ষেত পরিচর্যা করছি দিনের পর দিন। মজুরি দিয়ে কাজ করাই। এত কিছুর পরেও আমাদের উৎপাদিত ফসল কেজিতে গড়ে ৩-৪ টাকা লাভ করেই খুশি থাকতে হয়। অথচ অসাধু পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিছু টাকা বিনিয়োগ করেই দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ লাভ পকেটে নিয়ে ঘরে ফেরে। সরকার যদি এদিকে নজর দিতো তাহলে চাষিরা তাদের পরিশ্রমের দাম পেতো।
শুধু সোবাহান, শরিফুল আর আলমগীর হোসেনই নন, এমন হতাশা দেখা গেছে নওগাঁ জেলার সব উপজেলার চাষিদের চোখেমুখে। মাঠপর্যায়ে তারা কঠোর পরিশ্রম করে শাক-সবজি উৎপাদন করছেন, অথচ লাভ নিয়ে যাচ্ছেন পাইকারী ব্যবসায়ী আর ফড়িয়ারা। গ্রাম থেকে শহরের বাজারে প্রচুর শাক-সবজি এলেও দাম পাচ্ছেন না উৎপাদনকারীরা। শহরের খুচরা বাজারে তিনগুণ চারগুণ দাম যাচ্ছে খুচরা বিক্রেতাদের পকেটে। কৃষিপণ্যের ন্যায্যদাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত চাষিরা।
বিষয়টি উপলব্ধি করে বিক্রেতারাও বলছেন, পাইকারি বাজারে দালাল ও ফড়িয়া না থাকলে চাষিরা বেশি লাভবান হতেন। খুচরা বিক্রেতারাও কমদামে কিনতে পারতেন। গ্রামগঞ্জের পাইকারী বাজারে যে বেগুন ২৫-৩০ টাকায় কেনা হয়েছে শহরের খুচরা বাজারে তার দাম বেড়ে হয় ৭০ থেকে ৮০ টাকা। গ্রাম থেকে কেনা ৮ থেকে ১০ টাকার লাউ শহরের বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০-৪০ টাকায়। ১০ থেকে ১২ টাকা কেজির করলা বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা দরে। প্রতি কেজি ঢ্যাঁড়স ১৫-২০ টাকা কেজি দরে গ্রাম থেকে কিনে শহরের খুচরা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে ৪৫-৫৫ টাকা দামে। রমজানে ক্রেতাদের চাহিদা বেশি থাকায় লেবুতে সবচেয়ে বেশি মুনাফা পাচ্ছেন ফড়িয়ারা। বাগান মালিকদের কাছ থেকে প্রতি পিস ৩ থেকে ৪ টাকায় কিনে বিক্রি করছেন ৮ থেকে ১২ টাকায়।
নওগাঁর জেলা উপজেলার বিভিন্ন বাজারে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চাষিদের কাছ থেকে কম টাকায় বিভিন্ন শাকসবজি কেনেন। বেশি লাভের আশায় সেসব সবজি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়িদের কাছে বিক্রি করেন। কৃষকদের ঠকিয়ে স্থানীয় বাজারে বড় মুনাফা তুলে নেন পাইকাররা। পাইকারদের লাভের পর আরেক দফা লাভ তুলে নেন খুচরা বিক্রেতারা। চাষিদের কম দামে বেচা সবজি চড়া দামে কিনে খেতে হয় ভোক্তাদের। চাষি থেকে ভোক্তা পর্যন্ত তিন দফায় হাত বদলে মুনাফা চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পাকেটে। পকেট কাটা যায় ভোক্তার, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও বঞ্চিত হতে হয় চাষিদের। গত কয়েক দশক ধরেই এই চক্র চলছে। এখন অবধি এমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি যাতে চাষিরা ন্যায্য দাম পান আর ভোক্তাদের পটেক কাটা বন্ধ হয়।
আনন্দবাজার/শহক