ঢাকা | শনিবার
২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৬ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লোভের ফাঁদে নৌপথ

লোভের ফাঁদে নৌপথ

নৌ-দুর্ঘটনার ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার কোনো উদ্যোগ নেই দেশের নৌপরিবহন খাতে। বেশির ভাগ দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয় না। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অনিবন্ধিত নৌযানের নিবন্ধন যেমন করা হচ্ছে না তেমনি নিয়মিত সার্ভেও করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) প্রয়োজনীয় উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। নৌ-দুর্ঘটনা কমাতে নৌপথে ছোট আকারের লঞ্চগুলো দ্রুত অপসারণের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

বেসরকারি সংস্থা কোস্ট বিডির গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, গত ২০ বছরে দেশের নৌপথে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৩টি। এতে প্রাণহানি ঘটেছে দেড় হাজারের বেশি। অন্যদিকে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান বলছে, গত অর্ধযুগে নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে তিন হাজার ৩৪৫ জনের। শুধু গত বছরেই (২০২১) নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে ৯০টি। যাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৯৮ জন। নিখোঁজ হয়েছেন ১৮৬ জন। আর আহত হয়েছেন ৩৩৯ জন।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) বলছে, জাহাজ বা লঞ্চের নকশা অনুমোদন, সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট দেয়া, যাত্রীবোঝাইকরণ, যাত্রীবাহী নৌ-যানের চলাচলের অনুমতি ও চলাচল নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগের দুর্বলতায় অব্যাহতভাবে ঘটে চলেছে নৌদুর্ঘটনা। সেই সঙ্গে সব সরকারের সময়েই সড়কমুখী উন্নয়ন কর্মকৌশল এবং নদীবিমুখ নীতির ফলে নৌপথে যাতায়াত কঠিন হয়ে পড়েছে। আইন প্রয়োগে অবহেলা ও নৌপথে সমন্বিত কার্যক্রমের অভাব অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহনের অব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছতা, দুর্ঘটনা-দুর্যোগ এবং অক্ষমতার মূল কারণ বলে মনে করছে পরিবেশবাদী সংগঠন পবা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নৌ-আদালতে নৌ-দুর্ঘটনা সংক্রান্ত অসংখ্য মামলা চলমান। মামলাগুলোতে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ সাজা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। যে কারণে তাদের গ্রেপ্তারে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেকটাই উদাসীন। প্রতিবেদন অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয় না বললেই চলে। কখনো কখনো দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা কিংবা সাময়িক বরখাস্তের শাস্তি দিয়েই দায় এড়ানো হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লঞ্চ মালিকদের অতিরিক্ত আয়ের লোভের পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের নজরদারীর অভাবেই নৌপরিবহনখাতে নানা সংকট তৈরি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন রুটে ইচ্ছেমতো যাত্রী বহনের পাশাপাশি বেপরোয়াভাবে নৌ পরিচালনার কারণে ভয়াবহ সব দুর্ঘটনা ঘটছে। বড় থেকে শুরু করে এমএল টাইপের ছোট লঞ্চ এমনকি ট্রলারগুলো (ইঞ্জিন চালিত নৌ-যান) কোনো নিয়মনীতি মানছে না। লঞ্চমালিকরা অতিরিক্ত লাভের আশায় নিজেদের ইচ্ছেমতো নৌযান পরিচালনা করে থাকেন। ফলে প্রায় বছরই এসব রুটে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

যদিও দুর্ঘটনার পরপরই বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় নানান তৎপরতা শুরু করে। প্রতিবার দুর্ঘটনার পর নিয়ম অনুযায়ী গঠন করে দেয়া হয় তদন্ত কমিটি। পরে এ কমিটির প্রতিবেদন রহস্যজনক কারণে আর আলোর মুখ দেখে না। তাদের দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। ফলে বন্ধও হয় না ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

গত ১৭ মার্চের ছুটি কাটিয়ে চাঁদপুর থেকে ঢাকার উদ্যেশ্যে রওয়ানা দেন যাত্রীরা। অন্যান্য সময়ের তুলনায় এসময় যাত্রীর চাপ অনেকটাই বেশি। অতিরিক্ত লাভের আশায় প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে ধারণক্ষমতার কয়েকগুন বেশি যাত্রী নিয়ে রওয়ানা হয় আবে জমজম। ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়ার শুরুতেই যাত্রী চাপে একপাশে কাত হয়ে যায় লঞ্চটি। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কর্তৃপক্ষ লঞ্চটিকে ঘাটে নিয়ে আসে। যাত্রীদের নামিয়ে অন্য লঞ্চে উঠিয়ে দিয়ে লঞ্চটিকে ঘাটে রেখে দেয়া হয়।

অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনের লোকজন লঞ্চে আসেন না, পরীক্ষাও করেন না। তারা তাদের অফিসেই বসে থাকেন। লঞ্চটি চলাচলের উপযুক্ত কি-না, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া হচ্ছে কি-না তা সরজমিনে দেখেন না। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ অফিসে গিয়ে অর্থের বিনিময়ে কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে চলে আসেন। পরে ইচ্ছেমতো যাত্রী তুলে ছুটে চলেন গন্তব্যে।

চাঁদপুর-বরিশালগামী বিভিন্ন যাত্রীবাহী লঞ্চ ঘুরে এবং যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি লঞ্চেই মাস্টার থাকেন চার থেকে পাঁচ জন। তাদের কক্ষের এক পাশে থাকে বিছানা পাতা। পালাক্রমে দুয়েকজন ঘুমান, আর বাকিরা লঞ্চ পরিচালনা করেন। তবে অভিযোগ রয়েছে চলাচলের সময় সেখানে বিশ্রাম নেয় যাত্রীরা। টিকিটের অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে যাত্রীদের কাছে ভাড়া দেয়া হয় মাস্টারদের সিট। এতে করে রাতের নির্দিষ্ট একটা সময়ে ঘুমের সুযোগ থাকলেও তা সম্ভব হয় না মাস্টারদের। ফলে চোখে ঘুম নিয়েই লঞ্চ পরিচালনা করে। এতে করে অনেক সময় লঞ্চ উঠিয়ে দেয়া হয়ে বিভিন্ন বালুচরে। ধাক্কা দেয়া হয় বালু বোঝাই ট্রলারে। ঘটতে থাকে একের পর এক দুর্ঘটনা। প্রাণ হারায় সাধারণ মানুষ।

এ বিষয়ে একাধিক লঞ্চের মাস্টারের সঙ্গে কথা হয় দৈনিক আনন্দবাজারের এই প্রতিবেদকের। জানতে চাইলে অনেকে বিষয়টি এড়িয়ে যান। এক লঞ্চের মাস্টার বলেন, আমার সিটে যাদের দেখছেন এরা আমার আত্মীয়। দীর্ঘদিন পর দেখা হয়েছে। তাই কথা বলতে বলতে যাচ্ছি। তবে পরিচয় গোপন করে আরেকটি লঞ্চে মাস্টারদের সিট ভাড়া নিতে চাইলে তিনগুন বেশি দামে ভাড়া দিতে রাজি হয় সেই লঞ্চের এক মাস্টার।

নুর হোসেন নামে ভোলাগামী এক যাত্রী বলেন, আগে নিয়মিত কেবিনে করে যাতায়াত করতাম। এখন মাস্টারের সিটে করে যাতায়াত করি। কেবিনের চেয়ে এখানে ভাড়া কিছুটা কম। তারা দুয়েকবার চা-কফি দেয়। কেবিনে করে গেলে প্রকৃতি দেখা যায় না। এখানে সুয়ে বসে প্রকৃতি দেখতে দেখতে যেতে পারি। যাত্রীদের অনেকে বলছেন, লঞ্চে উঠলে আমরা দোয়া দরুদ পড়ে নিই। কখনও দুর্ঘটনা ঘটে তার কোনো ঠিক নেই। তাছাড়া কেউ কোনো নিয়ম মানেন না। যাত্রীদের জীবন যে তাদের হাতে সেটাও তাদের মনে থাকে না।

অভিজ্ঞরা বলছেন, মানুষ সাধারণত অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার তদন্ত কমিটি গঠন হয়। ঘটনার পেছনের কারণ খুঁজে বের করা হয়। তাতে কারো না কারো ভুলের খতিয়ান বের হয়ে আসে। তবে প্রতিবেদনে যে সুপারিশ করা হয়, তা কেউ আর আমলে নেয় না। অতীতের ভুল থেকে কেউই শিক্ষা নেয় না। বার বার একই ভুল হতে থাকে। এর পেছনে রয়েছে, বিচারহীনতা। দায়ী বা দোষীরা যখন আড়ালে থাকে তখন অন্যরা একই ভুল করতে দ্বিধা করে না। এমনভাবেই চলছে নৌপরিবহন খাত।

অথচ প্রাচীনকাল থেকেই সহজ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নৌপথ অনেক জনপ্রিয়। উপমহাদেশে যুগ যুগ ধরে যোগাযোগের প্রধান ভরসা নদীপথ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশেও সবচেয়ে সহজসাধ্য হিসেবে নৌপথ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। বিশেষ করে নদী আর সমুদ্র উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দাদের যোগাযোগের প্রধান ও নিরাপদ মাধ্যম জলপথ বা নৌপথ। এ পথে প্রতিনিয়তই যাতায়াত করেন লাখ লাখ মানুষ। অর্থ সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক হওয়ায় দক্ষিণের মানুষের পছন্দের শীর্ষে এখন নৌপথ। তবে প্রতি বছর বড় বড় সব নৌদুর্ঘটনা পছন্দের পথটিকে করেছে অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ। আগামীর সম্ভাবনাময় নৌখাতকে অনিরাপদ করে তুলেছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন