ঢাকা | শুক্রবার
৩রা জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১৯শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভয়াবহ পানিসংকটে বিশ্ব

ভয়াবহ পানিসংকটে বিশ্ব

বিশ্বের নানামুখী জরুরি সংকটের মধ্যে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে পানি সংকট। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীর প্রত্যন্ত প্রান্তেও বিস্তৃত হয়েছে ভয়াবহ এই সংকট। জাতিসংঘ বলছে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ পানির চরম সংকটে ভুগবে বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ। বিশ্ব সংস্থাটির চলতি বছরের পানি উন্নয়ন প্রতিবেদনে গবেষকেরা বলেছেন, বিগত ২০১৮ সালে বিশ্বের প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি মানুষ অন্তত একমাস পানিসংকটে ভুগেছে।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব বলছে, বাংলাদেশ নদ-নদী আর খাল-বিলের দেশ হয়েও সুপেয় পানির সুযোগবঞ্চিত জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে সপ্তম। সুপেয় পানির এই সংকট দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। বিশেষত, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট অসহনীয় হয়ে উঠেছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, গেল ২৫ বছরে উপকূলীয় জেলাগুলোর পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা গড়ে বছরে ২৬ শতাংশ হারে বেড়ে যাচ্ছে।

সুপেয় পানির সংকটের পাশাপাশি পানিতে লবণাক্ততা বাড়ার ফলে উপকূলীয় বাসিন্দাদের রোগব্যধি যেমন বেড়ে যাচ্ছে, তেমিন নানা ধরনের সমস্যায় পড়ছেন বিশেষ করে নারীরা। শুধু পানির অভাবেই শত শত মানুষ উপকূল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। এতে একদিকে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে বাস্তুচ্যুত মানুষ শহর এলাকায় আশ্রয় নেয়ায় সেখানেও পরিবেশগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। গবেষণার তথ্য বলছে, সংকটময় এই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে উপকূলীয় এলাকায় ২০৫০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা আরও ১৩ লাখ কমে যেতে পারে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী তিন দশক ধরে প্রতিবছর বিশ্বে পানির ব্যবহার ১ শতাংশ বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানি সরবরাহের প্রচলিত উৎস খাল ও বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বেড়ে যাবে ভূগর্ভস্থ পানির চাহিদা। বতর্মানে বিশ্বের ৯৯ শতাংশ সুপেয় পানি আসে ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে। কিন্তু এর গুরুত্ব না বোঝা, প্রতিনিয়ত অবমূল্যায়ন করা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে এই সরবরাহব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কাজেই এ সমস্যা মোকাবেলা করতে হলে পানির অপচয় রোধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপের দাবি ওঠছে বিশ্বব্যাপি। নয়তো এই সংকট আগামী কয়েক দশকে আরও খারাপ হতে পারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

২০১৫ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্টে পানি সংকটকে বৈশ্বিক হুমকির তালিকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শরণার্থী সংকট ও সাইবার আক্রমণের ওপরে স্থান দেয়া হচ্ছে। জলবায়ু বিষয়ক জাতিসংঘের প্যানেলের গবেষণা বলছে, প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য ২০ ভাগ বিশুদ্ধ পানি কমে যাচ্ছে৷ এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে ৪০ ভাগ পানি সংকট দেখা দেবে। তার ওপর এ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে পানির চাহিদা বাড়বে ৫৫ ভাগ। তাই একটি সমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজন দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

২০১৮ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পানিসংকটের মুখোমুখি হয়েছিল প্রতিবেশি ভারত। দেশটির সরকারি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ভারতের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে খাওয়ার পানির নির্ভরযোগ্য কোনো উৎসের সুযোগ থাকবে না।

‘দ্য ওয়ার্ল্ডস ওয়াটার’ বইয়ের লেখক পিটার গ্লাইকের উদ্ধৃতি তুলে ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, মানুষ যেভাবে সময়ের আগেই এসব পানি ব্যবহার করে ফেলছে, তাতে এই পানি এখন অনবায়নযোগ্য হয়ে গেছে। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হারে কমে যাচ্ছে ভূগর্ভের পানির স্তর।

কানাডার ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরেটাস গ্রাহাম কোগলি বলেন, ইন্দো-গাঙ্গেয় সমতলে, (অর্থাৎ, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রায় ৬০ কোটি মানুষের বাস) খুবই অনিয়ন্ত্রিত ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ হারে মাটির নিচের পানি তুলে ফেলা হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, এই বেসিনের ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রায় অর্ধেক আবার ব্যবহারের অযোগ্য। কারণ, এতে লবণাক্ততা ও আর্সেনিকের মাত্রা অনেক বেশি। তাই এগুলো পান করা বা কৃষিকাজে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন