ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তথ্য বিভ্রান্তিতে পুঁজিবাজার

তথ্য বিভ্রান্তিতে পুঁজিবাজার

অর্থ আত্মসাতসহ বিভিন্ন অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার কারণে অস্থির হয়ে পড়ছে পুঁজিবাজারের সিকিউরিটিজ হাউজগুলো। আইনের ফাঁক ফোকর কিংবা সামান্য ভুলে বিনিয়োগকারীদের অর্থ সুক্ষ্মভাবে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। কখনো কোম্পানিগুলোর মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আগাম প্রকাশ করে শেয়ার দর বাড়া বা কমানো কাজে লিপ্ত রয়েছে তারা। এছাড়াও শেয়ার দর বাড়া বা কমার গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশকিছু চক্র নীরবে এসব কাজ করে যাচ্ছে। তারা রেগুলেটর, স্টক এক্সচেঞ্জসহ সিকিউরিটিজ হাউজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।

তবে পুঁজিবাজারকে অস্থির করে তোলা নীরবে কাজ করে যাওয়া সেই চক্রকে ঠেকাতে নানা উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। ঢাকা স্টক এক্সছেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বলছেন, অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়ম রোধে ডিএসই খুবই সতর্ক। অনিয়ম হলেই আমরা সঙ্গে সঙ্গে অনুসন্ধান করছি। সমস্যার সমাধান করছি। তবে পুঁজিবাজারে যারা বিনিয়োগ করছেন তাদের অনেক সতর্ক থাকতে হবে। হাউজের ওপর পুরোপুরি নির্ভর না করার পরামর্শ দেন তিনি।

নিজের বিনিয়োগ তথ্য প্রতিদিন সিডিবিএল ( সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড) ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করার অনুরোধ জানিয়ে শাকিল রিজভী বলেন, কোনো সিকিউরিটিজ হাউজ যদি আপনার বিনিয়োগে কোনো অনিয়ম বা আত্মসাৎ করে, তবে সিডিবিএলে ওয়েবসাইট থেকে সহজেই ধরতে পারবেন। এর মাধ্যমে আপনার বিনিয়োগ নিরাপত্তা বাড়াতে পারবেন। এ ব্যাপারে কারো সহায়তার প্রয়োজন হবে না।

অন্যদিকে, অর্থ আত্মসাতসহ অনিয়ম প্রতিরোধে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। তিনি বলেন, অনিয়মের ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেবে না বিএসইসি। আবার পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সব ধরনের অনিয়ম রোধে বদ্ধপরিকর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান। তিনি বলেন, কোনো ধরনের অনিয়ম সহ্য করা হবে না।

এদিকে, অনৈতিক কাজে জড়িয়ে যাওয়ার কারণে সম্প্রতি উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. আব্দুল লতিফকে ডিএসইর প্রধান রেগুলেটরি কর্মকর্তার (সিআরও) পদ থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতি, প্রতিদিনের লেনদেনের তথ্য বাইরে প্রচার, বেশকিছু হাউজের বড় অনিয়মসহ ডিএসইর কিছু সদস্যকে অনৈতিক সুবিধার অভিযোগ রয়েছে।

ডিএসইর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আব্দুল লতিফের দুর্বল মনিটরিং ও নিজের স্বার্থ হাসিল করার কারণেই কয়েকটি ব্রোকারেজে বড় ধরনের অনিয়ম দিয়েছিল। বানকো সিকিউরিটিজে ডিএসই তদন্ত করে বিনিয়োগকারীদের হিসেবে ২০ কোটি বেশি দেখেছিলো। পরবর্তীতে বিএসইসির নির্দেশে তদন্ত করলে সেখানে ৬৬ কোটি টাকা নেগেটিভ পাওয়া যায়। এ অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় ডিএসই। এছাড়া ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ, তামহা সিকিউরিটিজ, মডার্ন সিকিউরিটিজসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম পেয়েছিল ডিএসই।

ডিএসইর আরেক কর্মকর্তা বলেন, এর আগে ডিসেম্বরে গ্রাহকদের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তামহা সিকিউরিটিজ ব্রোকারেজ থেকে শেয়ার লেনদেন স্থগিত করেছিল ডিএসই। হাউসটি প্রায় দুই হাজার গ্রাহকদের শেয়ার ও জমা করা অর্থের হিসাব রাখতে দুটি পৃথক ব্যাক অফিস সফটওয়্যার ব্যবহার করে একটি দিয়ে প্রকৃত তথ্য এবং অন্যটি দিয়ে ভুয়া প্রতিবেদন তৈরি করতো। এর আগে গত বছরের জুনে গ্রাহকদের ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ অফিস বন্ধ করে। ওই জুনে গ্রাহকদের ৬৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বানকো সিকিউরিটিজের লেনদেন স্থগিত করে ডিএসই।

প্রায় সাত কোটি টাকা হিসেবের গরমিল প্রসঙ্গে মডার্ন সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুজিস্তা নুর-ই-নাহরিন বলেন, সিকিউরিটিজের হিসাবের গরমিল নিছকই একটি দুর্ঘটনা। যা ডাটা এন্ট্রির ভুল। কোম্পানি থেকে কোনো টাকা খোয়া যায়নি। বাকিদের প্রসঙ্গে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোতে যোগাযোগ হলে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, হরেক রকম কোম্পানির শেয়ার দর বাড়া বা কমার আগাম তথ্য প্রচারে মুখরিত হয়ে উঠেছে পুঁজিবাজারের সিকিউরিটিজ হাউজগুলো। এসব তথ্যের ওপরে নির্ভর করে বেশকিছু কোম্পানির শেয়ার দর বাড়া কমাতে পুঁজিবাজারে এখনোও ইতিবাচক গতিতে ফেরানো কঠিন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে শেয়ার দর নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্যে গুরুত্ব দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। সেজন্য আগাম তথ্য গুজব হলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্যান্সার দেখা দেয় বলে জানান বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ।

পুঁজিবাজারের ইতিবাচক স্বাভাবিক গতি আনতে কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আদান প্রদানসহ গুজব বন্ধের ওপরে জোর দাবি জানিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আগাম তথ্য ও গুজব বন্ধে রেগুলেটদের আরও শক্ত অবস্থান রাখতে হবে। পাশাপাশি কারা তথ্য জড়াচ্ছে, তাদের ধরতে হবে। এতে যদি তালিকভুক্ত কোম্পানির, সিকিউরিটিজ হাউজ, স্টক এক্সচেঞ্জসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জড়িত থাকে তাদের ব্যাপারেও কঠোর নীতিতে যেতে হবে। একইসঙ্গে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আদান প্রদানসহ গুজব বন্ধে রেগুলেটদের সহায়তা করার পরামর্শ দেন।

মতিঝিলের প্রায় ১০টি সিকিউরিটিজ হাউজের সূত্রমতে, আগাম তথ্য আদান প্রদান করে অনেকে লাভবান হলেও ধরা খেয়েছেন বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী। বর্তমান বাজারের হরেক রকমের শেয়ারের দর বাড়ার মিথ্যতথ্যে গুরুত্ব দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। দীর্ঘ ১১ বছর পর বাজার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পথে এসেও ফের পতনে পড়েছেন। এসময় কমেছে লেনদেন, সূচক, মূলধনসহ অধিকাংশ কোম্পানির দর। এমন পরিস্থিতি বেশি দিন চলতে থাকলে পুঁজিবাজারে পুনরায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

লঙ্কাবাংলা, ইবিএল ও ব্র্যাক ইপিএল সিকিউরিটিজ হাউজের কর্মকর্তারা বলেন, কোনো সময় বাজারে ধস নামে। ধসের খবর রাখতে বিনিয়োগকারীরা আগাম তথ্যের ওপর নির্ভর করে। যদি এটা ভুল ধারণা। তবে অর্থলগ্নি থাকায় অনেকে আতঙ্কে থাকেন। যে কারণে বাজার পরিস্থিতি জানতে তারা এসব তথ্যে নির্ভর করেন। এছাড়া অল্প সময়ে অধিক মুনাফার আশায় বিনিয়োগকারী এসবে কান দেন। কিন্তু যারা এসব তথ্য ছড়ান তারা লাভবান হলেও নিরীহ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন।

এসব ব্যাপারে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ের সত্যতা পাওয়া যায়। পাশাপাশি চিরাচরিত কিছু তথ্য সর্বদা ভর করে আছে বিনিয়োগকারীদের মাঝে। এগুলো হলো রাইট শেয়ার, মুনাফা, ডিভিডেন্ড, ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং কোম্পানির মূল্যসংবেদনশীল তথ্য। বিনিয়োগকারীদের অধিকাংশই এসব বিষয় পর্যালোচনা করতে পারেন না বিধায় তারা এসব তথ্যের ওপর নির্ভর হয়ে পড়েন। কোনো একটি কোম্পানি আর্থিক প্রতিবেদনে ভালো মুনাফা দেখাবে, ভালো ডিভিডেন্ড দেবে কিংবা ডিভিডেন্ড দেবে না অথবা রাইট শেয়ার ছাড়বে ইত্যাদি খবর প্রচারিত হলে বাজারে সংশ্লিষ্ট শেয়ারের দরে উত্থান-পতন হয়। এ সুযোগে একটি শ্রেণি হাতে থাকা শেয়ার কাঙ্ক্ষিত মুনাফা নিয়ে ছেড়ে দেয়। তবে পরবর্তীতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন নিরীহ বিনিয়োগকারী। তাই তারা এসব এলোমেলো তথ্যে বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ চান।

এদিকে, অনেকে কান কথা নির্ভর হয়ে সাময়িক লাভবান হলেও চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন একদিন। কান কথা থাকে বলেই কোনো শেয়ারের দর অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায় আবার একইহারে হ্রাস পায়। স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে কারণ দর্শানো নোটিশে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলা ছাড়া উপায় থাকে না।

তবে পুঁজিবাজারে দর বাড়া কমার সংবেদনশীল তথ্য থাকতে পারে উল্লেখ করে ডিএসইর সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল হাশেম বলেন, সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা অবশ্যই থাকতে হবে। তবে তারপরও সত্য মিথ্য যাচাই করতে হবে। ড. আবুল হাশেম মনে করেন, ভিত্তিহীন কোনো তথ্যে বা কথায় বিনিয়োগ করা ঠিক হবে না। কারণ কারো বিনিয়োগের দায় কেউ নেয় না।

পুঁজিবাজারের শেয়ার দর বাড়া কমার আগাম তথ্য প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এসব কারণেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না পুঁজিবাজার। শিগগিরই এসব বন্ধ করতে হবে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন