বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে জাতিসংঘের জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর নেতৃত্বে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের সার্বিক ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নও বাস্তবায়নে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিকে বিবেচনার বিষয়ে সরকার জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। জলবায়ুর প্রভাবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পরিকল্পনায় আগামী ৩০ বছরে ৮৪ বিলিয়ন ডলার দরকার হবে।
গতকাল রোববার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘উন্নয়ন পরিকল্পনা, প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্তিকরণ’ বিষয়ক আলোচনা সভায় এসব বক্তব্য উঠে আসে। এতে প্রধান অতিথির হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান।
জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বা ন্যাপ প্রণয়ন ও অগ্রগতি নিয়ে আয়োজিত সভায় খসড়া তুলে ধরেন সিইজিআইএসের নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান। উপস্থাপনায় জানান, সারাদেশকে ১১টি জোনে বিভক্ত করে ১৩টি জলবায়ু ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, ঘুর্ণিঝড়, তামমাত্রা বৃদ্ধিসহ নদীভাঙন। এসব ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে ৬টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে অভিযোজন পরিকল্পনায়। যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। দুর্যোগ সহনীয় শহর গড়ে তোলার পাশাপাশি মানুষের চাহিদা মেটাতে প্রাকৃতিক সমাধানে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে।
এদিকে প্রতিবছর ৩ থেকে ৬ মিটার সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে ১০ শতাংশ উপকূলীয় অঞ্চল পানির নিচে চলে যাবে। ৫০ সেন্টিমিটারও যদি লবণাক্ততা বাড়লে ৫০ কিলোমিটার এলাকায় কৃষি ও পানি সংকট তৈরি হবে। এসব সমস্যা সমাধানে ১৩টি থিমেটিক এরিয়া চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে পানি ব্যবস্থাপনা থেকে কৃষি, মৎস ও বাস্তুসংস্থানকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এসব এরিয়া থেকে ১০৯টি পদক্ষেপ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে ৫০টি পদক্ষেপকে অগ্রাধিকার বিবেচনা করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ১৫টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। যা আগামী ২৭ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৪ বিলিয়ন ডলার।
২০৫০ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে এসব প্রোগ্রাম বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১৫ লাখ কোটি টাকার বেশি। এসব বাস্তবায়নে জলবায়ু আইন করার পাশাপাশি ব্যাক্তিখাতকে অন্তভূক্তির কথা বলা হয়। তাছাড়া মনিটরিং ও মূল্যায়ন বিভাগের মাধ্যমে প্রতি ৫ বছর পরপর এ পরিকল্পনা সংস্কার করার কথা বলা হয় খসড়া অভিযোজন পরিকল্পনায়।
অনুষ্ঠানে ন্যাপ বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যারয়ের এমিরেটরস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রির মধ্যে রাখার কথা বলা হলেও আইপিসিসি বলছে এটা ৩ থেকে সাড়ে ৩ ডিগ্রিতে চলে যাবে। এমনটা হলে বাংলাদেশে খাদ্য সংকট দেখা দিবে। এখনই বৃষ্টির অভাবে শ্রীমঙ্গলে চায়ের উৎপাদন কমে গেছে। লালমনিরহাটে আমন ধান লাগানো যায়নি।
এজন্য আলাদা জলবায়ু আইন দরকার বলে মনে করছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ। ন্যাপ মনিটরিংয়ে আইএমইডি পর্যাপ্ত নয় বলেও মনে করেন তিনি। আগামী ২০-৩০ বছর পরে ঢাকার জলাবদ্ধতা চিন্তাও করা যায় না বলেও সতর্ক করেন তিনি। গতবছর রংপুরে ৪৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে যা ঢাকায় হলে পুরো শহর তলিয়ে যাবে। থেমে থেমে বৃষ্টি হয় বলে আগামীতে ম্যালেরিয়া বাড়বে। এমন তথ্য জানিয়ে ন্যাপ বাস্তবায়নে এখনই মাস্টারপ্ল্যান দরকার বলে মনে করেন তিনি।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি বলেন, ২০১৯ সালে পোড়া ইটের ব্যবহার হ্রাসে সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে কেউ তা মানছে না। ২০১৯-২০ সালের মধ্যে তা ২৫ ভাগ হ্রাসের কথা ছিল। এমতাবস্থায় পোড়ানো ইটের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ব্লক ইটের ব্যবহার বৃদ্ধিতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে জানান মন্ত্রী। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে এটা নিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দেন তিনি। এ সময় মন্ত্রী বলেন, আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমার মন্ত্রণালয় জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করবে।
সভায় অর্থনীতি সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হতে জাতিসংঘ আমাদের কোভিড ও জলবায়ু বাধার কথা বলেছিল। কোভিড মোকাবেলা করা হলেও আমরা এখন জলবায়ু নিয়ে ভাবছি। ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে ৬টি নদীর পানি দূষণমুক্ত, নাব্যতা রক্ষা ও পানির মান নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাংক কাজ করছে বলেও জানান তিনি। ফলে ঢাকাকে বাঁচানো সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ইআরডি সচিব।
অনুষ্ঠানের মুক্ত আলেচনায় অংশ নিয়ে আলোচকরা দেশের অভিযোজন পরিকল্পনায় কার্বন নিঃসরণে কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে জানান। তবে প্যানেলের পক্ষ থেকে ২৩টি কার্বন নিঃসরণ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। যদিও ড. আইনুন নিশাত মনে করেন কার্বন নিঃসরণ নিয়ে বাংলাদেশের মাথা ব্যাথার কোনো কারণ নেই। এখানে শূন্য দশমিক ৩ থেকে ৩ শতাংশ নিঃসরণ হয়ে থাকে। ফলে এখানে দেশের পরিকল্পনা ৫০০ শতাংশ সফল হলেও তা বৈশ্বিক ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব রাখবে না বলে মনে করেন তিনি।
ব্যয় নির্ধারণ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলা হয় জাতিসংঘ এ ব্যয়কে কম বলছে। তাই এটাকে এ বছর আরো সংস্কার করার কথা বলছেন তারা। আইনুন নিশাত বলেন, বরিশাল, গোপালগঞ্জ, ঝালকাঠি, মাদারিপুর, ফরিদপুর ও শরিয়তপুরেই আরো ৫০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হতো। যদি তাদেরকে আন্তর্ভূক্ত করা হতো।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি সুদিপ্ত মুখার্জী বলেন, বিগত দশকে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা, দুর্যোগ মোকাবেলা ও অর্থনীতিতে অনেক আগ্রসর হয়েছে। গত ৫ বছরে দেশে তথ্যের সংকটের কথা অনেকবার শুনেছেন জানিয়ে তিনি তথ্যের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করেন এ উন্নয়ন সহযোগী। প্রাইভেট খাতকে অন্তর্ভূক্ত করার কথা বলে দরকষাকষিতে দক্ষতা উন্নয়নে ইউএনডিপি কাজ করছে বলে জানান তিনি। আরেক বিশেষ অতিথি পরিকল্পনা বিভাগের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ইটের পরিবর্তে ব্লক ইট ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করবে পরিকল্পনা বিভাগ। এসময় বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব স্বীকার করে নেন এ সচিব।
সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ প্রণীত জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্ব সভায় জলবায়ু যোদ্ধা হিসেবে আরো গ্রহণযোগ্য করবে। তিনি বলেন, ন্যাপে অন্তর্ভুক্ত পরিকল্পনা মোতাবেক মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষম হবে বাংলাদেশ।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল সভাপতির বক্তব্যে থিমেটিক ক্যাটগরিতে গৃহহারাদের সংযুক্ত করতে বলেন। ইটের বিষয়টি দেখার নিশ্চয়তা দেয়ায় তিনি পরিকল্পনা বিভাগকে ধন্যবাদ দিয়ে টপ সয়েল রক্ষার অঙ্গিকার ব্যক্ত করেন।
সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, ন্যাপ প্রণয়ন প্রকল্পের জাতীয় প্রকল্প পরিচালক এবং মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জলবায়ু পরিবর্তন) মো. মিজানুল হক চৌধুরী, ইউএনডিপি বাংলাদেশ এর আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জি প্রমুখ। খসড়া ন্যাপ উপস্থাপন করেন ন্যাপ প্রণয়ন কমিটির টিম লিডার বিশিষ্ট জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এমিরেটস অধ্যাপক ডক্টর আইনুন নিশাত এবং সিইজিআইএস এর নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান।
আনন্দবাজার/শহক