বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জাহাজ এমভি বাংলার অগ্রগতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুসংবাদ দিয়েছে। দীর্ঘ একত্রিশ বছর পর বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে সমুদ্রগামী এ জাহাজ নোঙর করেছে আমেরিকার বন্দরে। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের বহরে মানসম্পন্ন জাহাজ না থাকায় দীর্ঘ এই সময়ে কোনো জাহাজের আমেরিকা প্রবেশের অনুমোদন মিলেনি।
অপরদিকে, জাহাজ থেকে নাবিকদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও আমেরিকার বন্দরে বাংলাদেশি জাহাজ প্রবেশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল তিন দশকের অধিককাল। এর মাধ্যমে আমেরিকায় বাংলাদেশি জাহাজ প্রবেশের দীর্ঘ অচলাবস্থার অবসান ঘটেছে। পাশাপাশি আগামীতে আমেরিকার সঙ্গে সরাসরি শিপিং বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব তৈরি হতে যাচ্ছে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিএসসি সূত্রমতে, এমভি বাংলার অগ্রগতি নামের জাহাজটি ৩২ হাজার টন কেইন মোলাসেস (আখের রসের বিশেষ লিকুইড বা চিটাগুড় জাতীয় পণ্য) নিয়ে উত্তর আমেরিকার দেশ এল সালভাদর থেকে আমেরিকার হিউস্টন বন্দরে যাত্রা করে। ২০ ফেব্রুয়ারি যাত্রা করে জাহাজটি ৭ মার্চ হিউস্টন বন্দরে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে নোঙর করে। জাহাজটিতে নারীসহ ২৭ জন নাবিক রয়েছেন। এদের সবাই বাংলাদেশি। জাহাজটি চীন থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগর হয়ে সাউথ আমেরিকা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে। আমেরিকার ক্লার্কসন নামের একটি শিপিং কোম্পানি ভাড়া নিয়ে জাহাজটি পরিচালনা করছে।
বিগত ১৯৯১ সালে একটি জাহাজের নাবিক পালানোর ঘটনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) বহরে থাকা জাহাজগুলোর একসময় পৃথিবীজুড়ে সুনাম ছিল। তবে নাবিক পালানোসহ কালক্রমে এ সুনাম ক্ষুণ্ন হয় মারাত্মকভাবে। বিশেষ করে শত শত নাবিকের জাহাজ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় ইমেজ সংকটে পড়ে বিএসসি। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো জাহাজ গেলে ওই জাহাজের দুই-চারজন নাবিক গা ঢাকা দেওয়া নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
সর্বশেষ ১৯৯১ সালে এমভি বাংলার মমতা আমেরিকার বন্দরে গেলে এক সঙ্গে ১৪ নাবিক যুক্তরাষ্ট্রে গা ঢাকা দেয়। পরে ওই জাহাজকে আনার জন্য দেশ থেকে অভিজ্ঞ একজন চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে পাঠানো হয়। তবে তিনিও আমেরিকার বিমানবন্দরে নেমে গা ঢাকা দেন। পরবর্তীতে অনেক দুর্ভোগ পোহানোর পর এমভি বাংলার মমতাকে ফিরিয়ে আনে বিএসসি।
এদিকে এ ঘটনায় বাংলাদেশ ও বিএসসি ইমেজ সংকটে পড়ে মারাত্মকভাবে। এ ঘটানার পর যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বন্দরে বাংলাদেশি পতাকাবাহী আর কোনো জাহাজ প্রবেশের অনুমোদন মেলেনি। অপরদিকে নানা কারণে বিএসসির জাহাজের বহর ক্রমান্বয়ে ছোট হতে শুরু করে। এরমধ্যে জাহাজ পুরনো হয়ে ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়াতে এক বছরে দশটি জাহাজ স্ক্র্যাপ করে বিক্রি করার মতো ঘটনাও ঘটে বিএসসিত। দীর্ঘদিনের পুরানো এ জাহাজগুলোও আমেরিকার বন্দরে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছিল না।
সূত্রমতে, আমেরিকার বন্দরে প্রবেশের আগে একটি জাহাজের বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এবং নিরাপত্তার বিভিন্ন সূচকে উত্তীর্ণ না হলে কোনো জাহাজকে আমেরিকার বন্দরে নোঙর করতে দেয়া হয় না। এই অবস্থায় ৩১ বছর বিএসসির কিংবা এদেশের পতাকাবাহী কোনো জাহাজ আমেরিকার কোনো বন্দরে প্রবেশের সুযোগ পায়নি। এতদূর পাড়ি দেয়ার মতো কোনো জাহাজও বিএসসির ছিল না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৮ সালে চীন সরকারের আর্থিক সহায়তায় এক হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বিএসসি ছয়টি জাহাজ নেনে। চীনের জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিএমসি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জন্য তিনটি বাল্ক ক্যারিয়ার ও তিনটি অয়েল ট্যাংকার প্রস্তুত করে। ওই জাহাজগুলো ২০১৮ সালের বিভিন্ন সময়ে বিএসসির বহরে যুক্ত হয়। এর মধ্যে এমভি বাংলার সমৃদ্ধি ইউক্রেনে রকেট হামলায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে ওই জাহাজটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ভাসছে ইউক্রেনের ওলভিয়া বন্দরে। ইউক্রেনে বিএসসির এ জাহাজ নিয়ে যখন হতাশার খবর, তখন আরেকটি জাহাজ ৩১ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর খবরে সংশ্লিষ্টদের মাঝে সমৃদ্ধির আশা জেগেছে।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘ ৩১ বছর পর বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ আমেরিকায় নোঙর করার এ সংবাদ আনন্দের। তিনি বলেন, অঘোষিতভাবে ৩১ বছর ধরে বন্ধ থাকা আমেরিকার শিপিং সেক্টরে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা আবারো উড়ার এ ঘটনা শিপিং বাণিজ্যের জন্য মাইলফলক বলা যায়। ইতোমধ্যে বিএসসির একটি জাহাজ অস্ট্রেলিয়ার বন্দরে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বের শিপিং সেক্টরে বিএসসির ফিরে পাওয়া এ সুনাম ধরে রাখতে সংশ্লিষ্টদের কঠোর দায়িত্বশীল হতে হবে।
আনন্দবাজার/শহক