রসে ভরপুর ফল আনারসের আদি উৎস দক্ষিণ আমেরিকা হলেও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে। চৌদ্দ শতকের দিকে ব্রাজিল থেকে ভারতবর্ষে আনারসের আগমন ঘটে। এক পর্যায়ে আসাম ও মণিপুর হয়ে সিলেটে চাষ শুরু হয়। ক্রান্তীয় অঞ্চলের গ্রীষ্মকালীন এ রসালো ফল বিশ্বের প্রায় সব দেশেই চাষ হয়। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় সিলেট, টাঙ্গাইল, ঢাকা ও রাঙামাটি জেলায়। এর মধ্যে টাঙ্গাইলের মধুপুরের আনারসের কোনো জুড়ি নেই।
স্থানীয় সূত্রমতে, ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে জায়েন্ট কিউ জাতের আনারসের প্রচুর আবাদ হতো। ১৯৪০ সালের দিকে সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলেন টাঙ্গাইলের মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামের আদিবাসী ভেরেনা সাংমা। তিনি সুস্বাদু সেই আনারস খেয়ে মুগ্ধ হয়ে চারা নিয়ে আসেন নিজ গ্রামে। তারপর বাড়ির আশেপাশে সেগুলো রোপন করেন। সুস্বাদু আর অত্যন্ত রসালো আনারস খেয়ে আশপাশ এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে সেই আনারস। পরে আউশনারা, আলোকদিয়া, বেরিবাইদ, অরণখোলা, জলছত্র, ইদিলপুর, দানকবান্দাসহ নানা প্রজাতির আনারসের চাষাবাদ শুরু হয় গোটা মধুপুরে। ব্যাপক জনপ্রিয় হয় মধুপুরের আনারস।
চাষিরা জানান, পানি জমে না এমন দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি আর আবহাওয়াই আনারস চাষের উপযোগী। এ হিসেবে আনারস চাষের সবচেয়ে উপযুক্ত মধুপুর অঞ্চল। এখানকার উৎপাদিত আনারস স্থানীয় ও দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়। তবে রসে ভরপুর, খেতে সুস্বাদু ব্যাপক সম্ভাবনাময় সেই আনারস এখন কৃত্রিম রসে পরিণত হচ্ছে। চারা থেকে পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক উপকরণ দেয়া হচ্ছে আনারসে। কৃত্রিম ও দ্রুততম সময়ে পাকানো ও দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণের জন্য মেশানো হচ্ছে মানব শরীরের জন্য বিষাক্ত ফরমালিন।
আসছে রমজানে থাকবে আনারসের ভরা মৌসুম। আর অতি মুনাফালোভীরা মৌসুমকে সামনে রেখে এখনই অপতৎরতা শুরু করেছে। যে আনারস পরিপক্ক হতে সময় লাগে অন্তত ১৮ মাস, ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যেই তা বাজারতাজ করতে মাত্রাতিরিক্ত হরমোন ব্যবহারের প্রস্তুতি নিয়েছে অসাধু চক্র। স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে, আনারসে ফুল এলেই স্প্রে করা হয় বেনসালফিউরন মিথাইল ও এসিটাক্লোর সমন্বয়ে গ্রোথ হরমোন।
সাধারণত গাছে ৬০ পাতা হওয়ার পর প্রাকৃতিকভাবেই আনারস ফল পাওয়ার কথা। অথচ ২৮ পাতা হওয়ার পরই দ্বিতীয় দফায় এক ধরণের ক্ষতিকারক হরমোন ব্যবহার করে অপরিপক্ক গাছ থেকে কৃত্রিমভাবে ফল বের করে আনা হচ্ছে। যে হরমোনকে স্থানীয় কৃষকরা ‘গর্ভবর্তী’ বলছেন। তাছাড়া আনারস খানিকটা বড় হলেও তাতে ইথোফন বা রাইপেন নামক রাসায়নিক স্প্রে করা হয়। যাতে মাত্র তিন থেকে চারদিনেই আনারস পরিপূর্ণ আকৃতি পায়।
তবে শুধুই ইথোফন বা রাইপেন নয়, স্থানীয়দের অনেকেই বলছেন, এর সঙ্গে পটাশ, ফরমালিন, শ্যাম্পু, সিঁদুর, স্প্রিরিটসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ স্প্রে করা হয়। এসব বিষাক্ত স্প্রে প্রয়োগের কারণে পতঙ্গ বা শিয়াল-কুকুরও আনারসের ধারের কাছে ঘেঁষতে পারছে না। অল্প সময়েই আনারস রঙিন করার জন্য তৃতীয় দফায় গাছে ক্ষতিকারক ক্রফকেয়ার, ফ্লুরা, ভিটামিন পিজিআর গোল্ডসহ বিভিন্ন ওষুধ স্প্রে করা হয়। ১৬ লিটার পানিতে দুই মিলিলিটার কেমিকেল মেশানোর নিয়ম থাকলেও ১০০ মিলিলিটার কেমিকেল প্রয়োগ করা হচ্ছে। সবচেয়ে স্প্রে করা হয় বিষাক্ত ফরমালিন।
জমিতে মাত্রাতিরিক্ত হরমোন প্রয়োগে আনারসের স্বাদ ও উপকারিতা নষ্ট হলেও এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই প্রান্তিক চাষিদের। ওষুধের প্রয়োগ নীতি না জেনেই তার নিজেদের ও অন্যের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলছেন। আবার কেউ কেউ জেনে-বুঝেও অতিলোভে ওষুধ প্রয়োগ করছেন। শুধু জমিতে নয় বাজারেও মেশিন নিয়ে কিছু ফরমালিন স্প্রেম্যান দেখা যায়। আনারসের বাগানে গিয়ে পরিপক্ক আনারসে ফরমালিন স্প্রে করে আসে তারা। আর স্প্রে করার একদিন পর কাটা হয় আনারস।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রমতে, চলতি বছরে মধুপুরে ৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে আনারসের আবাদ করা হয়েছে। এরমধ্যে জলডুবি, জায়ান্টকিউ আনারসের আবাদ সবচেয়ে বেশি। তবে এবার এমডি-২ নামের নতুন জাতের আনারস চাষাবাদে যুক্ত হয়েছে। যা আমদানি হয়েছে ফিলিপাইন থেকে। জায়েন্ট কিউ জাতের আনারস স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায় সাতদিন। অন্যদিকে এমডি-২ আনারস ২৮ দিন সংরক্ষণে থাকে। এ কারণে ফিলিপাইনের আনারস সারাবিশ্বে রপ্তানি করা সম্ভব হয়। অপরদিকে সুপার সুইট নামে পরিচিত এমডি-২ আনারসে মিষ্টি ও পুষ্টি রয়েছে অন্য আনারসের থেকে তিন গুণ বেশি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এক লাখ চারা এনে মধুপুর গড়ের ১৭ জন আনারস চাষিকে দেয়া হয়েছে। ১৪ থেকে ১৮ মাসের মধ্যেই ফলন আশা করছে কৃষি বিভাগ।
আনারস চাষীরা জানান, গাছ থেকে ফল বের হওয়ার আগে প্রথম রাসায়নিক দিতে হয়। তারপর ২০/২২ দিন পর আবার স্প্রে করতে হয়। দেড় মাস পর শেষবার ফল পাকানোর জন্য রাসায়নিক দিতে হয়। আনারস বড় করার জন্য প্লানোফিক্স, সুপারফিক্স, ক্রপসকেয়ার, অঙ্কুরসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল প্রয়োগ করা হয়। পাকানোর জন্য দেয়া হয় রাইফেন, হারবেস্ট, প্রমোট, সারাগোল্ড, ইটিপ্লিস, এ্যালপেনসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল। আবার কেউ কেউ এরচেয়েও বেশি সংখ্যায় রাসায়নিক প্রয়োগ করেন। দফায় দফায় রাসায়নিক দিলে আনারস আকারে বড় হয় এবং হলুদ রঙ হয়ে পেকে যায়।
মধুপুরের ওষুধ বিক্রেতারা জানান, ১৬ লিটার পানিতে দুই মিলিলিটার কেমিকেল আনারসে দেয়ার নিয়ম। অথচ কৃষক দ্রুত ফল বড় করার জন্য প্রায় একশ মিলিলিটার কেমিকেল প্রয়োগ করে। বিক্রেতারা বলছেন, ওষুধ ব্যবহার করা ক্ষতি না। এটা প্রয়োজন। তবে প্রয়োগ মাত্রা না জেনে অতিমাত্রায় ঔষধ প্রয়োগ করলে তখন ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায়।
আনারস ব্যবসায়ীরা জানান, কেমিকেল প্রয়োগ করায় আনারসের প্রতি ভোক্তাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে আনারস পাকলে ধীরে ধীরে বাজারে আনা হতো। ফলে চাহিদা বাড়তো, বিক্রি হতো বেশি, লাভও হতো বেশি। তবে কেমিকেল প্রয়োগ করায় একসঙ্গে জমির অধিকাংশ আনারস পাকে। বাজারে অতিরিক্ত ফল উঠে। এজন্য চাহিদা কমে যায়, লাভ কম হয়। তবে ভোক্তারা দেখতে সুন্দর, আকারে বড় আনারস চায়। কেমিকেল ছাড়া এটা সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কৃত্রিম রসের আনারসের জন্য কৃষক বা ব্যবসায়ীদের দায়ী করাও ঠিক হবে না। ভোক্তাদের বিষমুক্ত আনারসের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে হবে।
টাঙ্গাইল শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. সুজাউদ্দিন তালুকদার দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আনারসে যেসব কেমিকেল ব্যবহার হয় সেগুলো মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আনারসসহ যেকোনো ফলে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে শ্বাসনালী, লিভার, কিডনিসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও শিশুরা হুমকির মুখে পড়ে। এছাড়া কেমিকেল বিষয় ক্যান্সারের জন্যও দায়ী হতে পারে।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আল মামুন রাসেল দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, মধুপুরে ৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে আনারস আবাদ হয়েছে। এ বছরে এমডি-২ নামের নতুন জাতের আনারস যুক্ত হয়েছে। অতিমাত্রায় হরমোন ও ক্ষতিকারক ওষুধ প্রয়োগের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এসব বন্ধে নিয়মিত মনিটরিং হচ্ছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব ঔষধের ক্ষতিকারক দিকগুলো কৃষকদের মাঝে তুলে ধরা হচ্ছে। বিষমুক্ত আনারস চাষেও কৃষকদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
আনন্দবাজার/শহক