বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছেলেরা প্রদীপের সলতে, নারীরা জ্বালানি

সমাজের ‘ট্যাবু’ ভাঙার লড়াই

তোমার সৃষ্টিতে জগত সৃষ্টি, সাক্ষ্য হাজার কাহিনি।

স্তব্ধ হবে জাতি, আসবে অধিক ক্ষতি না হয় যদি নারী।

তোমার প্রেমে বিশ্ব সাজে, বিশ্ব আজ শুধু তোমারই।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের এক স্মারক দিবস। নারীর প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদে এক বলীয়ান পদক্ষেপ তুলে ধরাই দিনটির উদ্দেশ্য। আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারী সমাজের মুক্তির একটি পদক্ষেপমাত্র।

প্রতি বছর ৮ মার্চ বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। যদিওবা দিবসটির পূর্ব নাম ছিল ‘আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস’। বিশ্বব্যাপী এই দিবস পালনের মধ্য দিয়ে নারীদের পুনর্জাগরণের দ্বার প্রশস্ত হয়।

নারীরা সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকেই বঞ্চিত, অবহেলিত; পুরুষের হাত ধরেই সদা সৌভাগ্য প্রাপ্তি হয় বলে ধারণা এ সমাজের আর যত গঞ্জনা ছিল মেয়েদের রোজকার যত্ন-আত্তি তালিকায়।

এভাবেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা নিজেদের সম্মানের, অধিকারের দাবিতে রোজদিন মোড়ক উন্মোচন করে যাচ্ছে। তবে আদতে এ সমাজ এখনো মেয়েদের গৃহলক্ষ্মী মনে করলেও পুরুষদের সৌভাগ্যদাতা মনে করে। নারীদিবস উপলক্ষে আমরা কিছু নারীদের গন্তব্যের কথা বলি; হ্যাঁ গন্তব্যের যে বা যারা কিনা সমাজের ট্যাবু ভাঙতে এ যাত্রায় তৎপর হয়েছেন।

নিথরা মেহরাব, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

নারী! শব্দটার মাঝেই একটা মায়া জুড়ে রয়েছে। সমাজের একটা বিরাট অংশজুড়ে যার অবস্থান। আমার মা একজন চাকরিজীবী। তাই তার কাছে থেকেই প্রথম স্বাবলম্বী হয়ে ওঠাটা শেখা।

খুব ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির শখ ছিল। হাতের কাছে কিছু পেলেই তা দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করার একটা প্রবণতা সবসময়ই ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে টিউশনি এবং নানারকম ফ্রিল্যান্সিং করে নিজের খরচা চালানোর চেষ্টা করতাম। হঠাৎ করেই নিজের ভালোলাগার কাজটাকে একটু বড় করে ভাবা শুরু করি। সেখান থেকেই নৃ-Nree-র সৃষ্টি। যা আমার হাতে তৈরি গহনার একটি অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান।

আরও পড়ুনঃ  টানা তিন দিন শ্রীমঙ্গলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা

প্রথম থেকেই খুব ভালো সাড়া পেয়েছি এবং ধীরে ধীরে ব্যবসায়িক জগতে পা বাড়িয়েছি। এখন আমার ছোট্ট শখের জায়গাটি আমার নিজের খরচ চালানোর জন্য বিরাট বড় আস্থার। একজন নারী হিসেবে সমাজে নিজের অবস্থানটা শক্তভাবে জানান দেয়াটা খুব জরুরি, তেমনি লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজের ভালোলাগার কিছু নিয়ে কাজ করা এবং তা যদি প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়, তবে তা আশীর্বাদ স্বরূপ।

প্রথমদিকে পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসাকে প্রাধান্য দিতে বেশ হিমশিম খেয়েছিলাম। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে একভাবে শক্ত করে তৈরি করে নিয়েছি। পরিবারে বাবার পাশাপাশি মা উপার্জন করতো বলে, স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন আমার পরিবারের মানুষের হাত ধরেই শেখা। নিজোর হাত যখন ছোট্ট ব্যবসাটা শুরু করি, তখন আমার মায়ের থেকে ভীষণ সাপোর্ট পাই, তাকে দেখেই এবং তার অনুপ্রেরণাই আমার আত্মবিশ্বাসের ভিত মজবুত হয়।

আমাদের সমাজে মেয়েদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলাতে হলে মেয়েদের আত্মসচেতন হওয়ার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হতে হবে। নিজের মাঝে জন্ম নেওয়া বটগাছটাকা শক্তির উৎস ভেবে, বটের গুঁড়ির ভিত শক্ত করে হবে। ছেলেরা যদি প্রদীপের সলতে হয়, সেই সলতে প্রজ্বলনের জ্বালানি হবে নারীরা। আলো আঁধারের মেলবন্ধনে চলবে সমাজের উন্নয়ন।

ঐন্দ্রিলা রানী সরকার, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

আমরা দুই বোন। আমাদের কোনো ভাই নেই। পরিবার বাবা ছাড়া আর কোনো পুরুষ নেই। আমরা দুইজনই ছোট একটা সরকারি চাকরি করি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ার পাশাপাশি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করি। যা আমি আমার পড়াশুনার পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছি। প্রথমত পরিবার থেকে খুশি হলেও তাদের একধরনের আতংক ছিল যে পড়াশোনা, চাকরি পাশাপাশি চালানো সম্ভবপর হবে কিনা। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন ক্লাস, পাশাপাশি শিক্ষকতা উভয়ই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠলেও আমি আমার মনোবলকে হারতে দেইনি।

আরও পড়ুনঃ  কাওরান বাজারে ২ জন করোনা আক্রান্ত, লকডাউন আড়ত

মা বাবা ছোট থেকেই চিন্তায় থাকতেন, তাদের বার্ধক্যে কারা দেখাশুনা করবে, দায়িত্ব নেবে। বড় হওয়ার পর মা বাবাকে আমার বড় বোন, আমি দুইজন মিলে দেখাশুনা করি। আর্থিক অন্যান্য সব দিক দিয়েই। আমার পরিবারের ভেতর এখনো তারা এটা বুঝে উঠতে পারেনি আর মেনে নিতে পারেনি যে মেয়ে হয়েও আমরা নিজের অবস্থান থেকে সারাজীবন আমার বাবা মার দেখাশুনা করতে পারি। তাদের ধারণা শুধু ছেলে মানেই সম্পদ। মেয়েরা বোঝা।

আমি আমার পরিবার বংশের ভেতর এই ভ্রান্ত ধারণার পরিবর্তনে কিছুটা সফল বলা যায়। এ ভ্রান্ত ধারণার পরিবর্তনের চেষ্টা করছি। নারী যে একটি পরিবার, সমাজ, বিশ্বের অর্ধসম্পদ সেটা আমাদের নারীদেরই বুঝিয়ে দিতে হবে কাজের মাধ্যমে। এ জন্য সর্বপ্রথম নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে হবে। এর ফলে সমাজের ভ্রান্ত ধারণা যেমন পরিবর্তন হবে, সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনও সুন্দর হবে। ভবিষ্যতে নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে এভাবেই নিজেদের অধিকার ও সম্মান নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে।

নারীর ক্ষমতায়ন নারীদের পুনর্জাগরণের দ্বার উন্মোচক, যাতে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সকলভাবে উপকৃত হবে। নারীরা চাকরিক্ষেত্র ছাপিয়ে গণতন্ত্র নীতিনির্ধারণেও উৎসুক। রাষ্ট্রসংঘের মতে, পৃথিবীতে শুধুমাত্র তিনটি দেশের সংসদে ৫০ শতাংশ বা তার বেশি নারী রয়েছেন। শুধু ২২টি রাষ্ট্রের প্রধান পদে আসীন আছেন নারী।

রাষ্ট্রসংঘও জানিয়েছে, বর্তমান উন্নয়নের হার এবং লিঙ্গসাম্যের বিষয়টি বিবেচনা করে বোঝা যাচ্ছে, ২০৬৩ সালের আগে সংসদে নিজের স্থান পাকা করতে পারবেন না নারীরা। করোনা এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি নারীদের ক্ষমতায়নের বাধা তৈরি করলে নারীরা যদি একজোট হয় তবে বিশ্বজয় সুনিশ্চিত। তা হোক এভারেস্ট জয় নয়তো সংসদের অধিবেশনের নিয়ন্ত্রক। নারীরা যদি সচেতন এবং তৎপর হয় তবেই এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজেদের অবস্থান বিলীন রোধ করা সম্ভবপর হবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন