ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারীর নীরব লড়াই

নারীর নিরব লড়াই

ঘরে বাইরে হয়রানিতে বিপন্ন মানসিক স্বাস্থ্য

  • বিরূপ প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে

নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বৈরী পরিবেশেই নারীকে লড়াই করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। চরম প্রতিকূলতার লড়াই করে জাতীয় অর্থনীতিতে তারা নীরবেই অবদান রেখে যাচ্ছেন।

একজন নারী একজন পুরুষের তুলনায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিনগুণ এমন কাজ করে থাকেন, যা জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। নারীদের সেই নীরব অবদানের অর্থমূল্য প্রায় সাড়ে ১০ লাখ কোটি টাকার মতো: সিপিডির গবেষণা

দেশে শিক্ষার দ্রুত সম্প্রসারণে ছেলেদের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে রয়েছেন মেয়েরা। কর্ম-সক্ষমতা কিংবা দক্ষতার ক্ষেত্রে তারা সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতার মাপকাঠিতে দিন দিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে পার্থক্য কমে আসছে। একইসঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার সুযোগ তৈরি হওয়ায় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় ঘটছে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর। তারা ধীরে ধীরে সমাজের মূলধারার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছেন। গেল কয়েক দশকে কর্মক্ষেত্রে এভাবেই নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে বহুগুণ।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর দেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ছয় শতাংশ। গেল ৫০ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে। আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৫০ ভাগে উন্নীত করার অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয়, নারীর ক্ষমতায়নসহ নারী-পুরুষের সমতার অঙ্গীকার পূরণে বিভিন্ন পর্যায়ে অন্তত ৩০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথাও বলা হচ্ছে। আর কর্ম বা শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ যতই বাড়ছে, ঘর থেকে নারীদের বাইরে বের হওয়ার প্রয়োজন ততই বাড়ছে। সবক্ষেত্রেই পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে তাদের।

তবে কর্ম বা শ্রমবাজারসহ কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ যতটা বাড়ছে ঠিক একইহারে বেড়ে যাচ্ছে তাদের নিরাপত্তাহীনতা আর হয়রানির মাত্রা। বিশেষ করে শিক্ষার দ্রুত সম্প্রসারণে গত কয়েক দশকে দেশে উচ্চশিক্ষিত নারীর সংখ্যা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। তারা চাকরির বাজারে ঢুকে পড়ছেন। ঘর থেকে বেরিয়ে পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে তাদের চলতে হচ্ছে। শ্রমঘন শিল্পখাত থেকে শুরু করে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়, কখনও বা অফিসে কখনও বা মাঠে-ঘাটে চষে বেড়াতে হচ্ছে চাকরিজীবী নারীদের। তবে বাস্তবক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার বিষয় অনেকটাই উপেক্ষিত, কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। দৃশ্যত, নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির তেমন কোনো বদলই ঘটেনি। সাম্প্রতিক দুটি গবেষণার ফলাফল এমন তথ্যই দিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে (আগামী ৮ মার্চ) সামনে রেখে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন সম্প্রতি ‘তরুণীদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব’ শীর্ষক এক সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হচ্ছে, গণপরিবহনে যাতায়াতে ৮৪ শতাংশ তরুণী যৌন হয়রানির শিকার হন। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া মোট তরুণীর ৬৫.৫৮ শতাংশই শিকার হয়েছেন যৌন নিপীড়নের। আবার ৩৫.৪৯ শতাংশ তরুণী বিকৃত যৌন ইচ্ছার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বা কুদৃষ্টির শিকার হয়েছেন।

সমীক্ষায় আরো উঠে এসেছে, বেকারত্বের কারণে ১৪.৭৯ শতাংশ তরুণী মানসিকভাবে বিপর্যস্ততার শিকার হন। তাছাড়া শারীরিক অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হন ৬৯.৯২ শতাংশ তরুণী। তাদের মধ্যে অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছেন ৪৩.৮৯ শতাংশ। সমীক্ষায় আরো বলা হয়, শুধু নারী হওয়ার কারণে মতামত প্রকাশে বাধার মুখে পড়েন ৪৬ দশমিক ২৫ শতাংশ নারীকে। অন্যদিকে, নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ পাওয়া যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়াতেও। ধর্ষণের মতো অমানবিক নির্যাতনের সংবাদেও হাস্যরসাত্মক প্রতিক্রিয়া (রিঅ্যাকশন) দেখা যায়।

‘ইউজার রিঅ্যাকশনস টু রেপ নিউজ শেয়ারড অন সোশ্যাল মিডিয়া: অ্যান অ্যানালাইসিস অব ফাইভ ফেসবুক রিঅ্যাকশন বাটনস’ শীর্ষক গবেষণায় এমন চিত্র পাওয়া গেছে। যেখানে ধর্ষণের সংবাদে প্রতিক্রিয়ার ২৬ শতাংশ হাস্যরসাত্মক বা ‘হা হা’ রিঅ্যাক্ট দিয়েছেন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। গবেষণায় দেশের ১০টি গণমাধ্যমের ফেসবুক পেজে শেয়ার করা ৯৪২৯টি প্রতিবেদনে ব্যবহারকারীদের দেওয়া ৩৫ লাখ প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণার ফলাফল বিষয়ে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যারা এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তাদের বিজ্ঞানসম্মত যৌনশিক্ষা, বোধ ও শিষ্টাচারের অভাব রয়েছে।

মূলত, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির এমন বৈরী পরিবেশে নারীকে লড়াই করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সব সময়ই চরম প্রতিকূলতার সঙ্গে পথ চলতে হচ্ছে। তারপরও তারা নীরবেই অবদান রেখে যাচ্ছেন জাতীয় অর্থনীতিতে। গেল বছরে বিশ্বব্যাংকের উইমেন বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল ইনডেক্সে বলা হয়েছে, উন্নয়নের ভালো সুফল পেতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর পূর্ণাঙ্গ অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন।

মূলত, সংসার গোছানো থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণা পর্যন্ত নারীর সরব উপস্থিতি সভ্যতার ক্রমবিকাশকে ত্বরান্বিত করে চলেছে। পরিবারের পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণ, প্রজনন, সংসার ও আবাসকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন নারীরা। তাদের মেধা আর শ্রমের আর্থিক মূল্য রয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, একজন নারী একজন পুরুষের তুলনায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিনগুণ এমন কাজ করে থাকেন, যা জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। নারীদের সেই নীরব অবদানের অর্থমূল্য প্রায় সাড়ে ১০ লাখ কোটি টাকার মতো। আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’র জরিপ মতে, পরিবারে নারীদের কাজের আর্থিক মূল্য প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার মতো।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখানো হয়েছে, মূলধারার কর্মজীবী নয় এমন নারী গৃহস্থালি কাজে ব্যয় করেন প্রতিদিন গড়ে ৬ দশমিক ২ ঘণ্টা। অন্যদিকে একজন কর্মজীবী নারী ব্যয় করেন গড়ে ৩ দশমিক ৬ ঘণ্টা। অর্থাৎ নারীদের বেশিরভাগ শ্রমঘণ্টার কাজের মূল্যায়ন হয় না, স্বীকৃতিও মেলে না। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে যেসব নারী গৃহস্থালি কাজে যুক্ত তাদের কাজের কোনো পারিশ্রমিক ধরা হয় না। শুধু যারা মূলধারার কাজে যুক্ত তাদেরই পারিশ্রমিক হিসাব করা হয়। অথচ জাতীয় অর্থনীতিতে দুই ধারার কাজেই অবদান অসামান্য।

বিবিএসের তথ্য বলছে, দেশে ১৫ বছরের বেশি কর্মক্ষম প্রায় ১১ কোটি মানুষের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫ কোটির বেশি। অথচ কর্মবাজারে সক্রিয় মাত্র দুই কোটি নারী। বাকি তিন কোটির বেশি নারী কর্মবাজারে যুক্ত হলে দেশের জিডিপিতে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি ঘটবে। যা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।

তবে এজন্য আগে সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনটা জরুরি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন পুরুষরা। যেটা হতে পারে নিজ পরিবার থেকেই। মূলত, কর্মস্থলে পুরুষ আধিপত্যের কারণে কর্মজীবী নারীদের বেশি মানসিক চাপে থাকতে হয়। পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করা কিংবা বেশি পুরুষের মধ্যে কাজ করতে গেলে নারীদের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য, যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। গবেষকরা বলছেন, পুরুষ শাসিত কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে মানসিক চাপ বেড়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন বেশিরভাগ নারী।

আবার পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হলে কিংবা উপেক্ষার শিকার হলে নারীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। যা থেকে গভীর হীনম্মন্যতাবোধ, হতাশা, নিজেকে আড়াল করার প্রবণতা, রাগ, ক্ষোভের জন্ম হয়। এক পর্যায়ে যা নারীকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কেউ আবার মাদকাসক্ত হয়েও পড়তে পারেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় পরিচালিত এক জরিপের তথ্য বলছে, দেশে দুই কোটির বেশি মানুষ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। যাদের বেশির ভাগই নারী।

ঘরে কিংবা কর্মস্থলে এমনিতেই নারীদের প্রতিনিয়ত নিপীড়ন বা নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তার ওপর আবার গণপরিবহনে কিংবা পাবলিক প্লেসেও আতঙ্কে থাকতে হয় নারীদের। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে নারীদের কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। অংশগ্রহণ কমতে থাকে শ্রম কিংবা কর্মবাজারে। জাতীয় অর্থনীতিতেও কমতে থাকে অবদান। নারীর কর্মক্ষমতাকে কাজে লাগাতে কিংবা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বাড়াতে সবার আগে নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটাতে হবে। যার প্রথম ধাপ প্রবলমাত্রার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির নিয়ন্ত্রণ করা।

সংবাদটি শেয়ার করুন