ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লাগাম ছেঁড়া চিনি

লাগাম ছেঁড়া চিনি

বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এর মধ্যেই চিনির বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের প্রধান পাইকারি বাজারে চিনির লাগাম আলগা হয়ে পড়েছে। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে খাতুনগঞ্জে চিনির দাম বেড়েছে মণপ্রতি ৭০ টাকা। দীর্ঘদিন চিনির বাজার স্থিতিশীল থাকলেও আসন্ন রমজানকে পুঁজি করে চিনির দাম বাড়ায় চিন্তিত সাধারণ মানুষ।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, দীর্ঘ মোয়াদে চিনির দাম ও বাজার নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তুলতে সরকারের জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার গেল বছরে চিনির আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। তবে সম্প্রতি বিশ্ববাজারে দাম উর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণে চিনির বাজার লাগাম ছিঁড়েছে। দরে অস্বাভাবিক উঠানামা চলছে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দর বাড়ার বিষয় বাহানা মাত্র। আসলে নানা কারসাজি আর অজুহাতে কবলে দেশের চিনির বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে চিনি বিক্রির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়ার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রামের বনেদি পাইকারি বাজারখ্যাত খাতুনগঞ্জ ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে পাইকারিতে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) চিনি বেচাকেনা হচ্ছে দুই হাজার ৬৯০ টাকা দরে। পনের দিন আগে যা ছিল দুই হাজার ৬২০ টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, বর্তমানে চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের শীর্ষ দুই ব্যবসায়ী গ্রুপ। বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে যেমন ঠিক, তেমনি চিনির বাজারের যে নিয়ন্ত্রণ নেই সেটাও সত্য।

সংকটের সমাধান করতে তাৎক্ষণিকভাবে হয় সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, নয়তো দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে দেশে চিনির চাহিদা মেটাতে ব্রাজিল, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়া থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করছেন বেসরকারি আমদানিকারকরা। তারা সেই চিনি পরিশোধন করে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন। এতে চিনির নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বেসরকারিখাতে।

চিনির বাজারের অস্থিরতার পেছনের কিছু কারণ তুলে ধরে খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী বলছেন, বৃহৎ এই পাইকারি বাজারে পণ্য বেচাকেনা ও লেনদেনে যুগ যুগ ধরে কিছু প্রথা চালু আছে। নিজেদের সুবিধার জন্য অনেক প্রথা আছে যেগুলো আবার আইনগতভাবে স্বীকৃত নয়। এরমধ্যে অন্যতম ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) স্লিপ কেনাবেচা। চিনি কিংবা অন্য কোনো পণ্য কেনাবেচায় ডিও স্লিপ প্রথায় আগাম লেনদেন হচ্ছে। এতে পণ্য হাতে না পেলেও আগাম স্লিপ কেনাবেচা চলছে।

দেখা যাচ্ছে, কোনো কোম্পানি বাজার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্যের ডিও কিনে নিচ্ছে। তবে যে দরে ডিও কেনা হয়, তার বাজার দর যদি বেড়ে যায়, তখন পণ্যটি ডেলিভারি দিতে তারা গড়িমসি করে। আবার দেখা যায়, কোম্পানির পণ্যই আসেনি অথচ ডিও কিনে রেখেছেন অনেক বেশি। এর ফলেও কোম্পানি বাজারে পণ্য ডেলিভারি দিতে পারে না। ফলে এ সব পণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এক্ষেত্রে চিনির ডিও বেচাকেনাও বেশি হয়। এতে চিনির দাম বেড়ে যায় লাগামহীনভাবে। যা খুচরা পর্যায়ে গিয়ে ক্রেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।

দেশের চিনিকলগুলোতে ক্রমাগত লোকসানের কারণে উৎপাদন হ্রাস বা বন্ধ করে দেওয়ায় বাজার ধীরে ধীরে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ছয়টি চিনিকল বন্ধ করে দেয় সরকার। এ কারণে চিনির বাজার শতভাগ আমদানিনির্ভর হওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। দেশের ১৫টি সরকারি চিনিকলের মধ্যে মধ্যে বাকি ৯টিতেও উৎপাদন খুব একটা আশানুরূপ নয়।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, যখন কোনো খাদ্য বা ভোগ্য পণ্যের সরকারি মজুদ না থাকে বা কম থাকে তখন বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের হাতে। তারাই বাজারের সরবরাহ ও দাম ঠিক করেন। এতে বাজার প্রতিযোগিতা নষ্ট হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ, বর্তমানে দেশে সরকারি কোনো চিনি মজুদ নেই। যা উৎপাদন হচ্ছে তা মোট চাহিদার ২ শতাংশেরও কম। ফলে মওকা পেয়েছে আমদানিকারকরা। আমদানি খরচ বৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতেই পণ্যটির দাম বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে মিল মালিকদের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অগ্রাহ্যও করতে পারছে না সরকার।

চাল, ডাল ও পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে যখন স্বনির্ভরতার গল্প শোনাচ্ছে সরকার, তখন চিনির বাজার শতভাগ আমদানিনির্ভর হতে চলেছে। দেশের চিনিকলগুলোর প্রায় অর্ধেকই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাজারে চাহিদার তুলনা যোগান কমে গেছে। ফলে সরকারের হাতে মজুদ থাকছে না। এ কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির দামও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। বাড়তে বাড়তে চলে যাচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের নাগালের বাইরে।

খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে চিনির বাজার ওঠানামা করছে। আসলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে সেটি আমাদের দেশের বাজারে প্রভাব পড়ে। দাম বাড়লে অনেকে সিন্ডিকেট কারসাজির অভিযোগ তুলে। প্রকৃতপক্ষে চিনির বাজারে সিন্ডিকেট কারসাজি বলে কিছু নেই। আন্তর্জাতিক বাজার কমে গেলে দাম এমনিতে কমে যাবে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, চিনির বাজার নিয়ে কারসাজির ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে প্রশাসনের যেভাবে নজরদারি হওয়ার সেভাবে হচ্ছে না। প্রশাসনের নজরদারির অভাবেই ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করার সুযোগ পাচ্ছেন। আসলে আমাদের দেশে গুটিকয়েক চিনি আমদানিকারক আছেন। তারা নির্দিষ্ট কিছু ডিস্ট্রিবিউটরের মাধ্যমে চিনি বিক্রি করতেন। এভাবে চিনির বাজারটা পুরোপুরি তাদের দখলে চলে যায়। বর্তমান বাজারে সরকারি চিনিকলগুলোর চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া সরকারি চিনিকলগুলোর বিপণন অব্যবস্থাপনার কারণে বেসরকারি চিনির আমদানিকারকরা কারসাজি করার সুযোগ পাচ্ছেন।

একসময় দেশের উৎপাদিত চিনি দিয়ে বাজার চাহিদার অনেকটাই পূরণ হতো। দেশের সরকারি চিনিকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেটা অনেক কমে গেছে, যা সামনের দিনগুলোতে আরো কমতে পারে। এ ক্ষেত্রে রিফাইনারি মিলগুলোরও নানা অপকৌশল রয়েছে বলে আমরা মনে করি। দেশের বাজার যদি পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে যায় তবে ভোক্তারা আরো জিম্মি হয়ে পড়বেন। দাম বাড়লেও কারো কিছু করার থাকবে না। সরকার চাইলেও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এ জন্য চিনিশিল্পকে বাঁচাতে হবে, দেশে চিনি উৎপাদন বাড়াতে হবে। তাহলে অন্তত বাজারে ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে। বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলেও মনে করেন তিনি।

সূত্রে প্রকাশ, বছরে বাংলাদেশে ২৫ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে যার বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সরকারি মিলগুলোও বর্তমানে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ অবস্থায় দাম নিয়ন্ত্রণে ও চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচিত হবে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন