ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সহসাই কাটছে না সংকট

শিল্পায়নে গ্যাস সংকট

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে দেশে ব্যাপক শিল্পায়নের ধারা তৈরি হয়েছে। শিল্পখাত সম্প্রসারণে সাশ্রয়ী জ্বালানি হিসেবে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে প্রাকৃতি গ্যাসের। তবে চাহিদার তুলনায় জোগান তেমন বাড়ছে না। উল্টো গ্যাস সংকটের কারণে ব্যাপক চাপে পড়েছে শিল্পখাত। এতে বিপাকে পড়ছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। শিল্পায়নের পথে গ্যাস সংকটের চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রতিবেদক ইয়াহইয়া নকিবের তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব ‘সহসাই কাটছে না সংকট’।

যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪২তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়াবে ৪১তম। ২০২৬ সালে ৩৪তম ও ২০৩১ সালে ২৯তম। ২০৩৬ সাল নাগাদ ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বহু ধাপ ওপরে উঠে হবে ২৪তম অর্থনৈতিক শক্তি। অর্থাৎ আগামী ১৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৮ ধাপ এগিয়ে যাবে।

দ্রুত বর্ধনশীল বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতোমধ্যে ‘এশিয়ান টাইগার’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। গত এক দশকে গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি অর্জনের পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে শিল্পয়নের ব্যাপক বিকাশ। আর শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত করে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে সরকার ১০১টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। আর এসব শিল্প-কারখানায় চালু করতে সাশ্রয়ী জ্বালানি হিসেবে চাহিদা বাড়ছে গ্যাসের। তবে প্রতিনিয়ত ক্রমবর্ধমান এ চাহিদার তুলনায় গ্যাসের জোগান বাড়ছে না বরং কমছে। ফলে গ্যাস সংকটে চাপে পড়ছে শিল্পখাত। শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সাধারণ গ্রাহকদের ওপরও পড়ছে এর প্রভাব। দেশের সরবরাহকৃত গ্যাসের এক তৃতীয়াংশই আমদানি নির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি আর বর্তমানে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট চরমভাবে অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিচ্ছে আন্তর্জাতিক গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাকে।

দেশে বর্তমানে ৪৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। তবে পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাস উৎপাদনচিত্রে দেখা গেছে, জাতীয় গ্রিডে ২৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। সরবরাহ সংকটে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হচ্ছে। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত অর্থবছরে গ্যাসের দৈনিক গড় চাহিদা ছিল ৪৩০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে স্থানীয় উত্তোলন ও আমদানীকৃত এলএনজি মিলিয়ে সরবরাহ হয়েছে ৩০১ কোটি ঘনফুট। যার মধ্যে ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করে সরকার। অর্থাৎ সরবরাহকৃত গ্যাসের তিন ভাগের এক ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এ বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানির কারণে গ্যাসখাতে ভর্তুকি বেড়েছে। সে হিসাবে চাহিদার বিপরীতে দৈনিক সরবরাহের ঘাটতি ছিল প্রায় ১৩০ কোটি ঘনফুটে।

গ্যাস সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান-২০১৭ ও পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান সমন্বয়ের ভিত্তিতে বিইআরসি তথ্যমতে সামনে এ ঘাটতি আরো বাড়বে। ২০২৫ সাল নাগাদ তা বেড়ে ৩৯০ কোটি ঘনফুট হবে। ২০৩০ সালে এ ঘাটতি আরো বেড়ে দাঁড়াবে ৫৫৮ কোটি ঘনফুটে। গত দুই দশকে নতুন গ্যাসক্ষেত্র উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাড়েনি। ফলে বেড়েছে আমদানি নির্ভরতা। গত বছরের প্রথম দিকে স্পট মার্কেটে এলএনজি মূল্য যেখানে ইউনিটপ্রতি ৫ বা ৬ ডলার ছিল, বছর শেষে তা ইউনিটপ্রতি ৪০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ গত বছর কোনো এক সময় স্পট মার্কেট থেকে সর্বোচ্চ ৩৬ ডলারে এলএনজি কেনে এবং একসময় অতি উচ্চমূল্যের কারণে সাময়িকভাবে কেনা বন্ধ রাখে।

বিগত দুই দশকে বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের দুর্বল ধারা বাংলাদেশকে এলএনজি ফাঁদে ফেলেছে। ২০১৪ সালে সমুদ্র বিজয়ের পর পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার তার সমুদ্র অংশে বিরাট গ্যাসের ভান্ডার আবিষ্কার করে চলেছে। তবে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানায় কেবলই কর্মহীন স্থবিরতা ছিল। দেশে গ্যাসের সংকট মোকাবেলার জন্য এলএনজি আমদানির ওপরই নির্ভরশীল বাংলাদেশ। স্পট মার্কেটে পণ্যটির দাম আকাশচুম্বী হয়ে ওঠায় গত বছর স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা কমিয়ে দেয় বাংলাদেশ। এতেই দেশের শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহনসহ অন্যান্য খাত অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে উচ্চমূল্যেই স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ। বতর্মানে স্পট মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যেও জ্বালানি পণ্যটি ক্রয়ের সুযোগ একেবারে সংকুচিত করে ফেলেছে ইউক্রেন সংকট।

দেশে এলএনজি আমদানির কাজটি সম্পন্ন হয়ে থাকে পেট্রোবাংলার সাবসিডিয়ারি আরপিজিসিএলের তত্ত্বাবধানে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে কাতার ও ওমান থেকে এলএনজিবাহী কার্গো এসেছিল মোট ৬৬টি। এর মধ্যে কাতার থেকে ৪০টি ও ওমান থেকে ২৬টি কার্গো এসেছে। গত বছর দেশ দুটি থেকে আসা ৬৩টি এলএনজিবাহী কার্গোর মধ্যে ৩৯টি কাতার ও ২৪টি ওমান থেকে এসেছে। চলতি বছরে দেশ দুটি থেকে মোট ৫৬টি কার্গো আনার পরিকল্পনা রয়েছে আরপিজিসিএলের। এর মধ্যে ৪০টি কাতার ও ১৬টি ওমান থেকে আনার পরিকল্পনা রয়েছে কোম্পানিটির। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এ পরিকল্পনাও উচ্চাভিলাষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে দেশ দুটি থেকে প্রতি মাসে গড়ে চারটি করে অন্তত ৪৮টি কার্গো আমদানির বিষয়টি নিশ্চিত করতে চায় পেট্রোবাংলা। ফলে গ্যাস সংকট আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া ও ন্যাটোর দ্বন্দ্ব যত ঘনীভূত হচ্ছে তত উদ্বেগ বাড়ছে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ নিয়েও। বর্তমানে ইউরোপের গ্যাসের চাহিদার ৩৫ শতাংশ বা এক তৃতীয়াংশ মিটিয়ে থাকে রাশিয়া। এমন অবস্থায় ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্বে জ্বালানি সংকটে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে ইইউ। ইউক্রেন সংকটে ইউরোপীয় দেশগুলোকে পাশে আনতে মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র এখন ইউরোপকে রুশ গ্যাসের নির্ভরশীলতা থেকে বের করে আনতে চাইছে। স্পট মার্কেটের সরবরাহকৃত এলএনজিবাহী কার্গোগুলোর মুখ ইউরোপের দিকে ঘুরিয়ে দিতে রীতিমতো কূটনৈতিক তত্পরতা চালাচ্ছে বৈশ্বিক পরাশক্তি দেশটি।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, এশিয়ায় সরবরাহ কমিয়ে তা ইউরোপে পাঠানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইতে পারে কাতার। যদিও দেশটির জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী সাদ শেরিদা আল-কাবি বলেছেন, ইউরোপে গ্যাসের চাহিদার ৩০-৪০ শতাংশ একা রাশিয়াই পূরণ করছে। দেশটি ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিলে যে ঘাটতি তৈরি হবে, তা পূরণের সক্ষমতা কাতারের নেই।

সম্প্রতি ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির জন্য কাতারের আমিরকে অনুরোধ জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ বলছে, কাতারের পক্ষে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন অনুরোধ উপেক্ষা করার সম্ভাবনা কম। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে মার্কিন মিত্র দেশগুলো এখন কাতারের প্রতি অনেকটাই বৈরী হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় ভূরাজনৈতিক লাভের প্রত্যাশায় মার্কিন অনুরোধ ইতিবাচকভাবেই বিবেচনা করে দেখতে পারে দেশটি। সেক্ষেত্রে বিপাকে পড়ে যেতে পারে কাতারের গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতিগুলো, যার অন্যতম বাংলাদেশ। ফলে জ্বালানি সংকট প্রকট হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এগুলোর কোনো ওভার নাইট (রাতারাতি) সল্যুয়েশন নেই বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানিবিষয়ক এ উপদেষ্টা বলেন, দীর্ঘস্থায়ী বেশ কিছু সমাধান রয়েছে তবে এগুলো ২-৩ বছরের আগে সমাধান হবে না। দেশের গ্যাস ক্ষেত্র থেকে টেকনিক্যাল পদ্ধতিতে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। পেট্রোবাংলার সে সক্ষমতা নেই। তাই কনসালটেন্ট এনে গ্যাস উত্তোলন বৃদ্ধির জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে, বিনিয়োগ করতে হবে।

এ অবস্থায় এলএনজি আমদানিতে বিপাকে পড়েছে জ্বালানি বিভাগ। জ্বালানি বিভাগ বলছে, বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় দৈনিক ৯৫০ এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করতে প্রয়োজন বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা। শুধু গ্যাস আমদানিতে এতো টাকা দেয়ার সক্ষমতা নেই সরকারের।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরূল ইমাম বলেন, এলএনজির বাড়তি দাম সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরই চাপ ফেলছে। ফলে এটা সুবিধাজনক বলে মনে হচ্ছে না। অন্যদিকে গ্যাসের উত্তোলণ না বাড়ালে আমদানি ছাড়া উপায়ও নেই।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন