মার্চ ২২, ২০২৩

রবীন্দ্র নাথ দে ছিলেন একজন আদর্শ অধ্যাপক

প্রফেসর রবীন্দ্র নাথ দে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে দেশের বিভিন্ন সরকারী কলেজে সুনামের সাথে অধ্যাপনা করে পাবনা এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অর্থনীতির  বিভাগীয় প্রধান হিসেবে অবসর নেন। তিনি কর্মজীবনের বেশীরভাগ সময় অধ্যাপনা করেছেন তার নিজ জেলার সিরাজগঞ্জ সরকারী কলেজে। সিরাজগঞ্জে রবীন্দ্র নাথ দে শুধুমাত্র একজন অধ্যাপকই ছিলেন না, ছিলেন এক আদর্শের প্রতিক এবং ছিলেন একজন নীতিবান মানুষ। একারণে তিনি একাধিক পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন। সিরাজগঞ্জের আপামর জনসাধারণের কাছে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধেয় রবিদা। স্কুলকলেজের ছাত্রছাত্রী এবং তার সহকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন রবি প্রফেসর। আর তার সরাসরি ছাত্রছাত্রী যারা দেশবিদেশে ছড়িয়ে আছেন তাদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় রবি স্যার।

প্রফেসর রবীন্দ্র নাথ দে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে অর্থনীতি বিষয় ছাড়াও ইতিহাসে ছিলেন অঘাত জ্ঞানের অধিকারী। বিশেষকরে ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রতিটা ঘটনা ছিল তার নখদর্পণে। তিনি যেভাবে নির্দিষ্ট দিনতারিখসহ ইতিহাসের প্রতিটা ঘটনা মনে রেখেছন এবং সুযোগ পেলেই বিভিন্ন স্থানে তা উল্লেখ করেছেন তা অনেক ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষেও সম্ভব হয়না। এছাড়া তিনি ছিলেন একজন চমৎকার বক্তা। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় তিনি অর্থনীতি এবং ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে চমৎকারভাবে অনর্গল কথা বলে যেতেন। ক্লাসে রবি স্যার যখন পড়াতেন তখন একেরারে নিঃশব্দ নিরবতা বিরাজ করত এবং সকলেই গভীর মনোযোগের সাথে তার লেকচার শুনতেন। আমি অবশ্য তার সরাসরি ছাত্র হবার সুযোগ পাইনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অনেক অগ্রজ এবং সহপাঠী তার সরাসরি ছাত্র ছিলেন। তাদের কাছ থেকে জেনেছি যে রবি স্যার যে বিষয় ক্লাসে পড়াতেন সে বিষয়ে আর নতুন করে কোন নোটও তৈরি করতে হতোনা এবং বাসায় আর বারবার পড়ারও প্রয়োজন হতোনা। রবীন্দ্র নাথ দে একজন কঠোর প্রশাসকও ছিলেন। কলেজের যে কোন সমস্যা সমাধানে তার ভুমিকা ছিল সবার আগে। যত বড় ছাত্রই হোক না কেন সে রবি প্রফেসারের সমনে মাথা উচু করে দাঁড়ানোর সাহস পেতনা। তার এই অসাধারণ গুনের কারনেই কলেজের অধ্যক্ষ ছাত্রদের সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোন সমস্যা সমাধানে রবি প্রফেসারকেই দায়িত্ব দিতেন। ছাত্ররা তার কথার অবাধ্য হয়নি জন্যে তিনি কলেজের সমস্যাগুলোর সন্তোষজনকভাবে সমাধান করেছেন। আর এই কারণেও তিনি ছাত্রদের কাছে ছিলেন বেশী জনপ্রিয়।

আরও পড়ুনঃ  মধ্যবিত্ত প্রবীণ নারীর চ্যালেঞ্জ

তিনি ইংরেজিতেও ছিলেন বেশ পারদর্শী এবং স্নাতকোত্তর ক্লাসে ইংরেজিতেই লেকচার দিতেন এবং সেকারণেই উচ্চতর শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের কাছে তার ছিলে বিশেষ আবেদন। তবে ক্লাসের লেকচার ইংরেজিতে দিলেও তিনি বাংলা, একেবার খোদ সিরাজগঞ্জের ভাষাতেই সর্বত্র কথা বলতেন। পেশাগত প্রয়োজন ছাড়া কেহ ইংরেজি ব্যবহার করলে তিনি তা কখনই ভাল চোখে দেখতেন না এমনকি সে যদি তার নিকট আত্মীয়ও হয়। একারণে আমিরিকা-কানাডার ইংরেজি পরিবেশে বেড়ে উঠা নাতিনাতনিরা তার কাছে থেকে অনেক বকাঝকা খেয়েছে। তিনি তাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে ইংরেজি ব্যবহার বাড়ির বাহিরে কাজের জায়গায় বা ক্লাসে। অন্যত্র বাংলায় কথা বলবে। মাতৃভাষা বাংলা শেখার গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন যে যদি ভাল করে নিজের ভাষা বাংলা না জান, তাহলে তোমার অস্তিত্বই হুমকির মধ্যে থাকবে।

অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে তার এই বিষয়ে ছিল পাণ্ডিত্য এবং দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনীতির জ্ঞানের যে যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা আছে তাও তিনি ভালভাবে অবহিত ছিলেন। তাই চাইলে তিনি অবসারে যাবার পর সরকারের কোন পদে দায়িত্ব পালন করতে পারতেন, যা আমাদের দেশে খুবই নিয়মিত এবং লোভনীয় ঘটনা। কিন্তু তিনি এপথে কখনও অগ্রসর হননি। একবার তার এক প্রিয় ছাত্র যিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ছিলেন তিনি তাকে সাহস করে বলেছিলেন যে সরকারের অনেক প্রকল্পে আপনাদের মত অর্থনীতিতে বিজ্ঞ ব্যাক্তিদের প্রয়োজন রয়েছে। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন যে তোমাদের এই ধারণা মোটেই সঠিক নয়। আমি আমার পেশার সর্বোচ্চ পদে পৌঁছে অবসরে গেছি এবং আমার কোন অপ্রাপ্তি নেই। আমি এখন নিশ্চিন্তে অবসর জীবন কাটাবো এটাই স্বাভাবিক। এখন কোন পদ আগলে রেখে অন্যদের উঠে আসার পথ বন্ধ করার কোন অর্থ হয়না। তাছাড়া সবসময়ই নতুনরা পুরাতনদের চেয়ে অনেক বেশী পারদর্শী হয়।         

আরও পড়ুনঃ  চলন্ত ইতিহাসের বিদায়

তিনি সারা জীবন বাংলাদেশ তো বটেই, এমনকি সিরাজগঞ্জ ছাড়া অন্য কোথাও থাকার কথা কল্পনায়ও আনতে পারেননি। সিরাজগঞ্জের বাহিরে কোথাও স্থায়ীভাবে থাকার কথা বললে তিনি প্রচণ্ড রেগে যেতেন। কর্মজীবনে তিনি পদন্নোতি পেয়ে বদলি হয়েছিলেন ভোলা সরকারি কলেজে, মেহেরপুর সরকারি কলেজে, মুক্তাগাছা সরকারী কলেজে এবং পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। কিন্তু কোথাও তিনি সিরাজগঞ্জ ছেড়ে পরিবারপরিজন নিয়ে যাননি। আবার সিরাজগঞ্জ কলেজে থাকার জন্য কোনরকম তদবিরেরও আশ্রয় নেননি। অবসর নেবার পর তিনি স্থায়ীভাবে এই সিরাজগঞ্জেই বসবাস করতে থাকেন। অবসরে যাবার পর আমাদের দেশের সরকারী কর্মকর্তাদের অনেকেই তাদের বাকি জীবন বিদেশে কাটাতে চলে যান আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে তাদের সন্তানদের কাছে। এমনকি আমেরিকায় বসবাসরত তার বড় মেয়ে তাকে অভিবাসন দিয়ে নিয়ে এসেছিলান ঠিকই কিন্তু তিনি স্থায়ীভাবে থাকেননি। কিছুদিন থেকেই স্বপ্নের গ্রিনকার্ড ফেলে দিয়ে ফিরে যান তার নিজ শহর সিরাজগঞ্জে। আমেরিকায় থাকাকালে টরনটোতেও এসেছিলেন এবং আমি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে আপনার দুই মেয়ে আমেরিকা-কানাডা থাকে তাই আপনি খুব অনায়াসে অবসর জীবন এখানে কাটাতে পারেন। এব্যাপারে তার বক্তব্য খুব স্পষ্ট। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন যে এসব দেশ আমাদের জন্য নয়। এখানে সবকিছু যান্ত্রিক এবং কৃত্রিম। এখানকার জীবনে কোন প্রান নেই এবং নেই কোন আন্তরিকতা। তোমরা পেশাগত কারণে এখানে চাকুরী করছ এবং সেইসাথে হয়ত উন্নত জীবন উপভোগ করছ। কিন্তু আমাদের জন্য এই দেশ মোটেই নয়। শুধু আমাদের কেন, তোমাদের অবসর জীবনের জন্যও নয়। এখানকার পেশাগত জীবন শেষ করে ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠা করে তোমরাও দেশে চলে যেয়ে একদিকে যেমন দেশের মানুষের উপকার করতে পার, অন্যদিকে তেমনি নিজের মাতৃভূমিতে শেষ দিনগুলো কাটাতে পার। তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন যে দেশের মানুষের উপকার করার জন্য অর্থ সম্পদের প্রয়োজন হয়না। একটু ভাল কথা বলে এবং একটি ভাল উপদেশ দিয়েও অনেক উপকার করা যায়। এতেকরে যে অকৃত্রিম ভালবাসা তুমি তাদের কাছ থেকে পাবে তার কোন তুলনা নেই। এভাবে তোমাদের ছেলেমেয়েরাও বিদেশের কর্মজীবন শেষ করে নিজের দেশে শেষজীবন কাটাতে পারে এবং এভাবেই বিদেশে থেকেও নিজের দেশের সাথে নারীর সম্পর্ক অটুট রাখা যায়। জানিনা আমরা এমন আদর্শবান মানুষের আদর্শ উপদেশ পালন করতে পারব কিনা।

আরও পড়ুনঃ  গদ্যে লেখা মহাকাব্য

এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি খুব গর্ব করেই বলতেন যে আমি সিরাজগঞ্জবাসীর যে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পেয়েছি তা আর কোথাও পাইনি এবং পাবও না। তিনি এও বলেছিলেন যে আমি সিরাজগঞ্জে মারা গেলে সেখানকার মানুষ আমাকে যেভাবে বিদায় জানাবে তেমনটা আর কোথাও পাওয়া যাবে না। আসলে বাস্তবে হয়েছেও তাই। দেশের বিভিন্ন সরকারী কলেজে অর্থনীতিতে অধ্যাপনা শেষে আমেরিকার মত দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ ছেড়ে দিয়ে নিজ দেশ তথা নিজের জন্মস্থানকে ভালবেসে সেখানে বসবাস করেই চিরবিদায় নিয়েছেন স্বনামধন্য প্রফেসর রবীন্দ্র নাথ দে ২০২১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি। তিনি তার নীতি এবং আদর্শের জন্যই বেঁচে থাকবেন অগণিত ছাত্রছাত্রীদের মাঝে। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি। #                                       

নিরঞ্জন রায়, CPA, CMA, CAMS

সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার

টরনটো, কানাডা

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ই-পেপার
প্রথম পাতা
খবর
অর্থ-বাণিজ্য
শেয়ার বাজার
মতামত
বিশ্ব বাণিজ্য
ক্যারিয়ার
খেলার মাঠ
প্রযুক্তি বাজার
শিল্পাঞ্চল
পণ্যবাজার
সারাদেশ
শেষ পাতা